পাহাড় পাহাড় মন কেমন

  • লেখা ও ছবি – রাকা ত্রিপর্ণা চক্রবর্তী


সময় টা ২০১৮, মার্চে ইয়ার এন্ডিং প্রেসার চলছে, আর আমার মন পাহাড় খুঁজছে। তাই ঠিক করলাম এপ্রিলের মিড- এ পাহাড়ে যাবো। এদিক সেদিক খুঁজে একটু নিরিবিলি একটা জায়গার খোঁজ পেলাম, লাটপঞ্চার আর অহলদাড়া। নেট থেকে খুঁজে পেলাম আনমোল দাদাকে, ফোন করে অ্যাডভান্স বুকিং করা হয়ে গেল। কিন্তু লাটপঞ্চার যাব অথচ রুফৌস নেকড হর্নবিল, যাকে কিং অফ লাটপঞ্চার বলে তার ফটো তুলব না? যদিও আমি তখন পাখি কিছুই চিনি না এমন নয় তবে সেটা কাক শালিক টিয়া প্রভৃতিতে আটকে আছে। বাকি যারা পাখির ফটো তোলে, তাদের পাখির ফটো দেখে চোখ সার্থক করি। কিন্তু এবার এই আফসোস নিয়ে ঘুরতে যাব? অগত্যা একটা ইয়াব্বড় লেন্স কেনা হল। কিন্তু যাওয়ার আগেই বেশ মন খারাপ হয়ে গেল। সবাই বলছে এই সময় হর্নবিল পাবি না। আনমোল দাদা আর সঞ্জয় দাদা কিন্তু আশ্বাস দিয়েছিল। আর সেই ভরসাতেই পৌঁছলাম শিলিগুড়ি। রাতে পৌঁছে জানাতে ভুলে গেছি সঞ্জয় দাদাকে। ভোরবেলা উঠে মনে পড়াতে ফোন করলাম আর জানতে পারলাম সঞ্জয় দাদা রওয়ানা দিয়েছে গাড়ি নিয়ে। 
সেবক ধরে গিয়ে কালিঝোরা থেকে বাঁদিকে একটা ভাঙাচোরা রাস্তা উঠে গেছে, আর সেটা দিয়েই সঞ্জয় দাদা গাড়ি নিয়ে গেল। অদ্ভুত নিস্তব্ধতা সেই রাস্তার। জিজ্ঞেস করার আগেই বলল এটা দিয়ে গেলে এখনই হর্নবিল্ দেখতে পাবে। ওই হিন্দিতে বলে না মন মে লাড্ডু ফুটা, আমার অবস্থাটাও সেরকম। আস্তে আস্তে চোখ সয়ে যাচ্ছে। সবুজ আর খয়েরি মিশে গেছে। অনেক পাখির আওয়াজ কানে আসছে। গাড়িতে কোন শব্দ হচ্ছে না। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল সঞ্জয় দাদা; ফিস ফিস করে বলল spider hunter কিন্তু আমি দেখতে পেলাম না। তারপর আরও একটা দুটো ছোট ছোট পাখি, দেখতে পাওয়ার আগেই উড়ে গেল। সঞ্জয় দাদা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আমাকে পাখি দেখাবেই। কিন্তু আমি রাস্তায় চেনা লোক দেখতে পাই না, তাকে আবার অচেনা পাখি চেনাবার দায়িত্ব নিয়েছে দাদা। তবে মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছি প্রথম পাখি দেখতে আসা তো তাই বোধ হয় দেখতে পাচ্ছি না। তাই এভাবেই এগিয়ে চলা। সঞ্জয় দাদা বলে যাচ্ছে কোই বাত নেহি, ফির মিলেঙ্গে উও। রাস্তা খুবই খারাপ। কিন্তু মনের একটা আরাম অনুভব হচ্ছে। একটা একটু ফাঁকা জায়গায় এসে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল সঞ্জয় দাদা। দেখলাম পাশেই একটা ছোট্ট নালা তির তির করে বয়ে চলেছে। উঠে এলাম সেই জলের ধারাটা ধরে আরও একটু উপরে। সঞ্জয় দাদা একটা গাছ দেখিয়ে বলল উস পেড় পে হ্যায়। আমি দেখতে পাচ্ছি না। বসে পড়লাম মাটিতে। একটু ধাতস্থ হতে সময় লাগল। চোখ সয়েছে আস্তে আস্তে। সঞ্জয় দাদা একবারও তাড়া দেয়নি। একসময় কি একটা নড়ছে দেখতে পেলাম। দেখলাম খয়েরি মাথা ওয়ালা একটা হর্নবিল। এবার কাছে যাওয়ার জন্যে নেমে এলাম ওই উঁচু জায়গা থেকে।

একটা ডালে পুরুষ পাখিটিকে দেখতে পেলাম। এই পাখিটির নাম Rufous necked hornbill বা খয়েরি গলা ধনেশ। আর একটা মেয়ে পাখি অন্য গাছে বসে ছিল। একেই বলে কিং অফ্ লাটপঞ্চার। মেয়ে পাখিটির গায়ের রং কালো আর চোখের চারপাশ নীল আর গলাটা গেরুয়া এবং পুরুষ পাখিটির মাথা গলা উজ্জ্বল গেরুয়া আর চোখের চারপাশ নীল। এদের ডিম পাড়া থেকে বাচ্চা ফোটার সময় হল মার্চ থেকে জুন। এই সময় মেয়ে পাখিটি এক জায়গাতেই থাকে আর পুরুষ পাখিটি মেয়ে পাখি আর বাচ্চাকে খাবারের জোগান দেয়। তবে এই পাখিটি কনসারভেশন- এর আওতায় পড়ে এই মুহূর্তে। আমি সত্যি অভিভূত হয়ে গেছিলাম পাখিদুটিকে দেখে। একটা উঁচু গাছের বিভিন্ন ডালে দুটো পাখি খেলে বেড়াচ্ছিল। অনেকক্ষণ ধরে দেখলে বোঝা যায় তারা নিজেদের নিয়ে খুব ব্যস্ত কারণ নেস্টিং এর সময় চলে এসেছে। সঞ্জয় দাদার থেকে জানতে পারলাম এরা একটা গাছেই বছরের পর বছর বাসা বানায়। কোন কারণে সেই গাছ ভেঙে পড়লে তখন নতুন আস্তানার খোঁজ করে। আর এই পুরো অঞ্চলটা মহানন্দা বন্য প্রাণী সংরক্ষণের মধ্যেই। 

ওখান থেকে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌঁছলাম আনমোল ভাইয়ার হোম স্টেতে। আনমোল ভাইয়া আর ইয়াঙ্কি দিদি আপন করে নিয়েছিল। জানলা দিয়ে অহলদাড়া দেখা যায়, আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘাও। রেস্ট নিয়ে বেরোলাম আশেপাশে ঘুরে দেখব বলে। সবার বাড়িতেই অনেক ধরনের গাছ। এখানে চারদিকে সবুজ। মানুষগুলোও তাই খুব সতেজ আর সুন্দর। কিছু দূর এসে আবার বৃষ্টি পেলাম। আশ্রয় নিলাম একটা ছোট মনেস্ট্রিতে। নিচে দেখতে পেলাম কতগুলো বাচ্ছা স্কুল ছুটির পর বৃষ্টি ভিজতে ব্যস্ত আর তাতেই তাদের মুখে উজ্জ্বল হাসি। ওদের দেখে আমিও নেমে এলাম, হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেলাম মহানন্দার গভীর জঙ্গল। একদিকে সিঙ্কোনার চাষ হচ্ছে আরেকদিকে গভীর খাত আর জঙ্গল। রাস্তায় আর দু-চার জনকেই দেখতে পেলাম। আবার পৌঁছলাম সকালের ওই জায়গাটায় হর্নবিল দেখতে। বসে পড়লাম। রাজা বলে কথা, অত সহজে কি আর দেখা দেয়। আকাশ মেঘলা, দূরের গাছটাতে হর্নবিল দুটো ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে, কাছে আসতে তারা নারাজ। আরও অনেকগুলো পাখির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল কিন্তু আমি ব্যস্ত তখন আমার রাজা-রাণীকে দেখতে। আমি দু-চারটে ফটো তুলছি সঞ্জয় দাদার ইনস্ট্রাকশন মন দিয়ে শুনে আর পাখি দুটোকে দেখছি। অন্য পাখির নাম সঞ্জয় দা বলে যাচ্ছে, আমি শুনছি, শিখছি আর ভুলছিও। কিন্তু খুব কিছু দেখতে পায়নি। ভাগ্যিস আমার এই ভোলা স্বভাবে লোকে কিছু মনে করে না। বার দশেক করে এক একটা নাম বলে যাচ্ছে ক্লান্তিহীন ভাবে আর আমি চার বার গুঁতো খেয়ে এক একটা নাম হঠাৎ ইউরেকা বলে মনে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। তবে এখন বুঝি পাখিদের সাথে অভ্যস্ত হতে হয় নাহলে পাখিরা ধরা দেয় না। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসে এই ভাবেই, তাই হঠাৎ চা- চা- করে উঠল মন। চলে এলাম একটা ছোট্ট দোকানে, পাহাড়ের কোলে নিশ্চিন্ত আশ্রয়। চায়ের সাথে ওখানকার মানুষের গলায় সন্ধ্যের সুর। একটা ঘোর থাকে এসবের। ভেসে যাওয়া থাকে আর থাকে হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, সঞ্জয় দা তাড়া লাগালো “ঘর জানা হ্যায়”, ফিরে চললাম।

How many roads …….. No limits if you want to walk…হর্নবিল দেখে এমনিতেই মন খুশি খুশি আছে। ফিরে এসেই পকোরা আর চা খেতে খেতে আর কয়েকজনের সাথে পরিচয় হল। তারা একসাথে এসেছেন। সবাই ট্রেকার। ঠিক হল পরের দিন মহানন্দাতে এক জায়গায় মিট করব। সকাল সাতটা। পথে পেলাম আমার অন্যতম প্রিয় পাখি- লং টেলড ব্রডবিল, সবজে আর হলদে রঙের এই পাখিটা খুব মিষ্টি দেখতে। ওটা দেখেই পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম একটু বনের দিকে। একটা সরু পায়ে হাঁটা রাস্তা। নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। একটু একটু করে এগিয়ে গেলাম মহানন্দার দিকে। দেখতে পেলাম Blue throated berbet, Mountain imperial pegion, Ashy drongo, Himalayan bulbul ইত্যাদি। কত যে আওয়াজ আর তার যে মূর্ছনা সেটা কানে না শুনলে অনুভব করা যায় না। মহানন্দা গিয়ে যে কী দেখব সেটা নিয়ে কোন ধারণা নেই আমার। সঞ্জয় দাদা আর আনমোল ভাইয়া নিয়ে যাচ্ছিল, আমিও যাচ্ছিলাম। বেশ কিছুটা এসে যে পাখিটা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারলাম না সেটা হল, সিলভার ইয়ার্ড মেসিয়া। সঞ্জয় দাদা বলছে ফিস ফিস করে সিলভার ইয়ার্ড মেসিয়া। কিন্তু আমি ততোধিক কানা, দেখতেই পাচ্ছি না। যত বলে “উও পেড় কে পিছে দেখিয়ে” তত ভুলভাল দেখছি। আরে এ তো চারদিকে পেড় হি পেড় হ্যায়, খুঁজব কোথায়? তারপর চোখ কিছুটা ধাতস্থ হল। মনে হল কি একটা যেন লাফিয়ে যাচ্ছে এদিক ওদিক। মন বলছে, ভাই একটু সামনে আয়। যেমন রঙ সেরকম তার ডাক। লালে, হলুদে, কালোতে আর সিলভারে রঙ যেন চুঁইয়ে পড়ছে। ভোরবেলায় বৃষ্টি হয়ে গেছে। সবুজে সবুজ চারদিক। তার মধ্যে এ যেন অপ্সরা। কিন্তু মুখে একটাও আওয়াজ করা যাচ্ছে না। সঞ্জয় দাদার অসীম ধৈর্য যে আমাকে আস্তে আস্তে ফিসফিস করে এক্সাক্ট লোকেশন বলার চেষ্টা করছে। বেশ কিছুক্ষণ বাদে দেখতে পেলাম। এত রঙিন পাখি আমি তখনও দেখিনি। হাঁ করে গিলছি, না মানে দেখছি। শাটার আর প্রেস হচ্ছে না। সঞ্জয় দাদার কথায় ঘোর কাটল। দু-চারবার ক্লিক তারপর ইনি ফুড়ুৎ করে পালিয়ে গেলেন।


শুনলাম আগের দিন রাতে এই জায়গায় হাতি এসেছিল জল খেতে। ফরেস্ট ডিপার্ট্মেন্ট থেকে বেশি দূর যেতে বারণ করে দিল। একটাই রাস্তা, হাতি তাড়া করলে আমি তো খাদেই পড়ব। কেউই আর বেশিদূর এগোল না। একটু পরেই আবার বৃষ্টি শুরু হল। একটা বন বিভাগের বাড়িতে সবাই আশ্রয় নিলাম। দেখলাম একটা ব্ল্যাক ড্রংগো বৃষ্টিতে ভিজছে আর শিস দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ বাদে সবাই ফিরে চললাম বৃষ্টি না থামার জন্যে। প্রায় ১১টা তখন। তখনও অবিশ্রান্ত ধারা। সারাদিনের প্ল্যান ভেস্তে গেল। রোদ পেলাম দুপুরের পরে। রোদ ওঠার পর দুপুরের দিকে গেলাম অহলদারা আর নামথিং পোখরি। অহলদারা একটা ভিউ পয়েন্ট। কাঞ্চনজঙ্ঘা আর তিস্তা দুটোই দেখা যায়। কিন্তু ঘন মেঘের আস্তরণে কিছুই দেখতে পেলাম না। কিছুক্ষনের জন্যে মেঘের দেশে হারিয়ে গেলাম। দুটো পাহাড়ি কুকুর সঙ্গী ছিল সেখানে। আশেপাশে সিঙ্কোনার গাছ লাগানো হয়েছে। দূরের পাহাড়গুলো ঝাপসা। চোখ ঢেকে যায় ঘন মেঘে। অন্যদিকে রোদ আছে দেখা যাচ্ছে। মন ভালো করা বিকেল। ফেরার পথে একজন বয়স্ক লোকের সাথে দেখা হল, সঞ্জয় দা বলল আগে নাকি এখানকার একজন ভালো রাজমিস্ত্রী ছিলেন। এখন বয়স হয়েছে তাই পারেনা। সঞ্জয় দা কিছু টাকা ওনাকে দিলেন। দেখলাম অপূর্ব এক হাসি খেলে গেল ওনার মুখে। তৃপ্তির হাসি , ভালবাসার হাসি। ফিরে এসে আবার চায়ের আসরে আড্ডা বসল। সেখানেই জানতে পারলাম সুন্দর একটা মন ভাল করা ঘটনা। আমরা অনেকেই ফলসা নামক একটা ফলের গাছের কথা জানি। ওখানে কেউ একজন কলকাতা থেকে আনমোল ভাইয়া আর সঞ্জয় দাকে ফলসা গাছের চারা দিয়েছিল। সেগুলো এখন তিন ফুটের উচ্চতায় বড় হয়েছে, তারা যত্নও করছে। শুনেও ভাল লাগে। এত সবুজের মধ্যেও তারা কত সচেতন। আসলে প্রকৃতিই বোধহয় মানুষকে এভাবে ভাবতে শেখায়। শুরু হল, পাখি নিয়ে গল্প, কোথায় কোন পাখি কোন সিজনে পাওয়া যায় তার গল্প। তারপর আবার ঘুরে বেরানোর গল্প। একা চলার গল্প। মানুষের গল্প। ন’টা বাজে। ডিনার করে পরের দিনের মহানন্দার জন্যে সব এনার্জি সঞ্চিত করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

উপর থেকে নীচের খাদ, গাছপালা দেখতে ভালই লাগে। নিচে নামলে ব্যাপারটা কি হতে পারে তার আন্দাজ ধারণা কিছুই ছিল না। লং টেলড ব্রডবিল কে দেখতে দেখতে নেমে এসেছি বেশ কিছুটা। এবার আরও কিছুটা নামতে গিয়ে দুবার পা হড়কালাম। উরি বাবারে! আমার ক্যামেরা তখন সঞ্জয় দার হাতে। পিঠের ব্যাগটা আছে, মাথার টুপি বিট্রে করছে মাঝে মাঝে। মাথায় থাকব না বলে সে মাঝে মাঝেই স্থান চ্যুত হচ্ছে। নিজেকে সামলাব, পাখি দেখব নাকি সামনের পথ চলব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। রাস্তা বলতে কিছুই নেই, কতগুলো গাছ পাথরের উপর দিয়ে সঞ্জয়দা হেঁটে যাচ্ছে আমি দেখাদেখি তাই করছি। দূরে সাদা পাহাড় চূড়ো দেখা যাচ্ছে আর শোনা যাচ্ছে অজস্র নাম না জানা পাখির আওয়াজ। এই আওয়াজের একটা সম্মোহনী শক্তি আছে বোধহয়। কাছে টানবেই। পিছনে আনমোল ভাইয়া। এক জায়গায় আবার বুনো শূয়োর আওয়াজ করছে। আমি চমকে উঠলাম। তাও হেঁটে চলেছি, হঠাৎ একটা প্রাণীর আওয়াজ শুনতে পেলাম , জিজ্ঞেস করলাম কিসের আওয়াজ, সঞ্জয় দাদাই বলল, বার্কিং ডিয়ার। তারপরই বলে এখানে না লেপার্ড আছে, ওরা আগে বুঝতে পারে তাই সাবধান করে দেয়। এই শুনে আমার সম্মোহন তখন বিদায় নিয়েছে, জাস্ট মনে হচ্ছিল “আমি বাড়ি যাব”। ইত্যাবসরে আমরা এসে পৌঁছেছি একটা ঝর্ণার সামনে। আরে উপর থেকে যে ঝর্ণাটা দেখতে পাচ্ছিলাম সেটা এরকম চোখের সামনে চলে আসবে বুঝতে পারিনি। ঝর্ণাটা অপূর্ব। আনমোল ভাইয়া ঝর্ণাটার কাছে গিয়ে বসে পড়ল। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আর দেখা হবে কিনা জানি না। সঞ্জয় দা তখনও পাখি পড়াবার মত করে পাখির নাম আওড়ে চলেছে। তবে ছবি তোলার মত পরিস্থিতি ছিল না একদমই, কিন্তু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। পেরোতে গেলে ওই শ্যাওলা পাথরের উপর দিয়েই যেতে হবে। এবার একবার সঞ্জয় দা, পা হড়কালো। ওটা দেখে আমি নিজে কিভাবে পার হব বুঝতে পারছিলাম না। জুতো ভিজে গেল আর আমি হাচরে পাচড়ে একটা শুকনো জায়গায় উঠে এলাম। যাক বাবা!! বাঁচা গেল। কিন্তু না আমার তখনও আরও কিছু জিনিসের সাথে পরিচয় হওয়া বাকি। ও মা গো!! এরপরেই আসল খেল। জোঁক। পা বেয়ে জোঁক উঠছে। এ পা থেকে ছাড়ালে ওই পা, আর ওই পা থেকে ছাড়ালে এই পা। উরি বাবারে!! রক্ত যে এত মিষ্টি জানতাম না। আমি তো হাই হাই করে উঠলাম। মনে হচ্ছিল কতক্ষনে উপরে উঠে আসব। আর কিছুটা গেলাম এইভাবে। তারপর সেই চরম অনুভুতি এইতো উপরে উঠে আসার রাস্তা। “স্বর্গের রাস্তা” ফিল হতে থাকল। উপরে উঠে জল খেলাম। ঘন্টা তিনেক লেগেছিল কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল সারাদিন কেটে গেছে। আবার পায়ে হেঁটে ফিরে আসা নিজেদের আস্তানায়। দুপুর গড়িয়েছে। আমি খেয়ে উঠে আশেপাশে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেরালাম। পরিচয় হল, বিএসএফ- এর এক কর্মীর সাথে। সামনের দোকানের দিদিটার সাথেও গল্প করলাম কিছুক্ষণ। কাল তো ফেরার পালা। সন্ধ্যে নামার সাথে সাথেই বৃষ্টি শুরু হল। শুধু একটু দুঃখ হচ্ছিল এই ভেবে- একবারও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেলাম না। রাতে শুরু হল প্রলয়। ঘুম মাঝে মাঝে ভেঙ্গে যাচ্ছিল। প্রকৃতি বোধহয় সবসময় অবাক করে দেওয়ার জন্যেই থাকে। রাতে ওই ঝড় বৃষ্টির মধ্যেও বেশ ঘুমোলাম। সকালে উঠে চোখ মেলেই দেখি আকাশ পরিষ্কার, জানলা দিয়ে বাইরেরে আলো ঘরে ঢুকছে। জানলার দিকে চেয়ে দেখি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। লাফিয়ে উঠলাম। তাকিয়ে রইলাম এক রাশ মুগ্ধতা নিয়ে। ভুলে গেছি কোথায় আছি। বাইরের অল্প আলোর মধ্যেই ক্যামেরাটা নিয়ে দু-চারটে ফটো তুলে নিলাম। মনে মনে ভাবলাম কাল খুব করে চেয়ে ছিলাম একবার কাঞ্চনজঙ্ঘাকে যেন দেখতে পাই, সেই আশা পূর্ণ, তবে বৃষ্টি না হলে কিছুই দেখতে পেতাম না। মন খুব খুশি একবার দেখা পেয়ে। এরপর যদিও ফেরার পালা তবুও মনে হচ্ছিল আমার মত সুখী কে আছে? এই সুখের কাছে অন্য সব কিছু ভোলা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.