ভিয়েতনামের ১০ দিন… পর্ব ১

  • লেখা ও ছবি – সায়ন ভট্টাচার্য

হিসেব করে দেখলে ভিয়েতনামে আমি ৬ মাস কাটিয়েছি। যার মধ্যে শুধুমাত্র প্রস্তুতির জন্যই ৫ মাস ২০ দিন সময় লেগেছে। প্রথম বিদেশ ভ্রমণ বলে কথা, এটুকু উত্তেজনা বুকে জিইয়ে না রাখতে পারলে আর আনন্দ কিসের। বাকি ১০ দিন তো হুশ করে নাকের ডগা দিয়ে বয়ে গেল। তাই যদি তৃপ্তির কথা বলতে হয় সেক্ষেত্রে গোটা ৬ মাস ধরেই এই তৃপ্তির স্বাদ আমি সমান পেয়েছি। কিন্তু গল্পের থেকে তো ভূমিকা বড় হয় না। তাই ৫মাস ২০ দিনের কথা বাদ দিয়ে বাকি ১০ দিনের কথাই আপনাদের বলে রাখি স্মৃতি টাটকা থাকতে থাকতে।

দেশের বাইরে পা ফেললে, প্রথম পা পড়বে বাংলাদেশে। শুরু থেকেই এই ছিল আমার ইচ্ছা। আমাগো দ্যাশ। কিন্তু এই ইমোশনের থেকেও বড় হয়ে দাঁড়াল আমাদের রাজনৈতিক ইমোশন। “ যখন দেখবি চারদিক লাল পতাকায় মোড়া, মন জুড়িয়ে যাবে”… শুধুমাত্র এটুকু পেট্রোলই যথেষ্ট ছিল স্বপ্নের গাড়ি স্টার্ট নেওয়ার জন্য। ব্যাস তারপর আর দ্বিতীয় কিছু ভাবিনি। এই পেট্রোল যোগানের কাজটি যে করেছে, শুভ্রাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই।

প্রথমদিন (দুঃখিত ওটা প্রথম রাত হবে)

হ্যানয় এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন সারতে সময় লাগলো ১০ মিনিটেরও কম। হাত ঘড়িতে মোটে রাত ১২.৩০ কিন্তু ভিয়েতনামে তখন রাত ২টা। আলো না ফুটলে বাইরে বেরোনো ঠিক হবে না ভেবে এয়ারপোর্টের ফাঁকা চেয়ারেই যখন গা এলিয়ে দিয়েছি, তখনই একজন সোজাসুজি এসে জিজ্ঞাসা করল… সিটি সেন্টার ?? মনে হচ্ছে ইনি ক্যাব ড্রাইভার। জানিয়ে দিলাম যে দিনের আলো না ফুটলে আমরা বেরোব না। তখনকার মত বিদেয় হলেও অন্য কোন যাত্রীদের কাছে বিশেষ সুবিধা করতে না পারায় তাঁর পুনরাগমন ঘটল। “সিটি সেন্টার … ভেরি চীপ… সিটি সেন্টার … ভেরি চীপ…” বলতে বলতে চোখ মুখের এমন অঙ্গভঙ্গি করতে লাগল যেন আমরা বেজায় বোকা ওর সাথে যেতে চাইছি না বলে। “ডোন্ট ওয়ারী, ২৪আওয়ার হোটেল ওপেন…” ইত্যাদি বলে বলে মানুষটা সত্যি আমাদের দ্বিধায় ফেলে দিল। ভাড়া জিজ্ঞাসা করলাম -৫ লক্ষ ডং … এই নাকি ভেরি চীপের নমুনা। এয়ারপোর্ট থেকে সিটি সেন্টার প্রায় ৩০ কিমি। আমি ২ লক্ষ থেকে শুরু করলাম। শেষে ৩ লক্ষ ডং এ রফা হল। বাইরে বেরিয়ে দেখি ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে।

ট্যাক্সি চলতে শুরু করেছে। রাস্তা শুনশান। তার ওপর বৃষ্টি। হাইওয়ে ধরে গাড়ি ছুটছে, দুইপাশে ঘুমন্ত শহর। জানলার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে বাইরেটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা। বৃষ্টির জল চুঁয়ে নামছে। কই কিছুই তো খোলা দেখছি না। আমাদের মুখে কথা নেই। এত রাতে বিদেশ বিভূঁইয়ে এভাবে না বেরোলেই বোধ হয় ভালো করতাম। ড্রাইভার বাবুটি ভাব জমানোর যথেষ্ট চেষ্টা করছেন, কিন্তু আমাদের মনের ভাব তখন আশঙ্কা উদ্বেগে মাখামাখি। বেশ কিছুক্ষন চলার পরে রাস্তায় কিছু গাড়িঘোড়ার আনাগোনা পেলাম। দেখলাম একটা ফুলের বাজার। সেখানে বেশ কিছু লোকের ভিড়। আমাদের জগন্নাথ ঘাটের মত। সাইকেল, বাইক চড়ে মানুষ ফুল নিয়ে যাচ্ছে বোঝাই করে। বৃষ্টির মধ্যেই। মাথায় টোকা। মনে হতে লাগল মূল শহরে ঢুকে পড়েছি।

হোটেলের নাম ঠিকানা গুগলে বের করে দেখিয়েছিলাম ড্রাইভার বাবুকে আগেই। হোটেল না যদিও, একটা ট্যুরিজম এজেন্সির অফিস। আজ আমরা হোটেলে না, থাকবো হালং বে তে একটি ক্রুজে। সেই ক্রুজ সংস্থার অফিসই গন্ত্যব্য। বড় রাস্তা ছেড়ে গাড়ি অলিগলি রাস্তা ধরল এবং কিছুক্ষন পরেই সমস্ত আশঙ্কা সত্যি করে আমরা এসে পৌছালাম একটা ঘুমন্তপুরীর সামনে। প্রায়ান্ধকার গলি। দোকানপাট, হোটেল সমস্ত কিছুর দরজা বন্ধ। বিদেশ বলেই হয়ত মাথাটা গরম হয়নি তখনও। ড্রাইভারের যদিও কোন হেলদোল নেই। সে গাড়ি থেকে নেমে ঠিকানা খুঁজে, দরজায় কলিং বেল বাজাতে শুরু করে দিল। প্রথমটায় আশা জাগলেও, ১০ মিনিট পরেও যখন কারোর সাড়া শব্দ মিলল না তখন নিজেকেই গালাগালি দিচ্ছি মনে মনে। ড্রাইভার হাল ছেড়ে দিতে একরাশ দুশ্চিন্তায় তলিয়ে যেতে গিয়েও সামলে নিলাম। ততক্ষণে ৩.৩০ বেজে গেছে। ড্রাইভার এগিয়ে এসে বলল যে ও আমাদের কাছাকাছি একটা ক্যাফেতে নামিয়ে দিতে পারে যেখানে বসে আমরা সকাল না হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে পারি। মুহূর্ত দেরী না করে আমরা রাজি হয়ে গেলাম। হ্যানয়ের বিখ্যাত ট্রেন স্ট্রীটের কাছে একটা ফুটপাথীয় ক্যাফেতে নামিয়ে দিয়ে আমাদের ক্যাব চলে গেল। এলাকাটিতে তখনও বেশ কিছু খাবার দাবারের দোকান খোলা। রাস্তার ওপরেই ছোট ছোট টেবিল চেয়ার পাতা। মাথার ওপরে ত্রিপল। দোকানগুলো চালাচ্ছে মহিলারা। যাক বাবাহ… তাহলে ভয়ের কিছু নেই। নিশ্চিন্ত মনে একটা লিলিপুট চেয়ারে তশরিফ গুঁজে দিয়েই কফি অর্ডার করলাম সঙ্গে এক প্যাক সিগারেট। আরও ১ -২ ঘণ্টা এভাবেই কাটাতে হবে। ধোঁয়া ছেড়ে মগজে বার্তা পাঠালাম – অল ইজ ওয়েল। তখনও জানি না ওই ধোঁয়ার দামই ৫০০০০…

ভিয়েতনামী কফি

আলো ফুটতেই আস্তে আস্তে শহরের চেহারাটা পাল্টাতে শুরু করে দিল। আলতো ভাবে শুরু হয়ে গেল একটা দিন। সাইকেল ও স্কুটারের সংখ্যা বেড়ে চলল। সবার গায়ে পাতলা প্লাস্টিকের রেইন কোট আর মাথায় ভিয়েতনামী টোকা। ঢাউস ঢাউস মালের বস্তা উঠেছে ছোট ছোট স্কুটিতে। লাল নীল সবুজ রঙের ছোট ছোট বাস দৌড়ে যাচ্ছে। কলকাতার ট্রামের মত রাস্তার ওপর দিয়ে দুই বার ট্রেনও গেল। গণ পরিবহন ব্যবস্থা বেশ ভালোই মনে হয়। যে ফুটপাথ গুলো সারারাত দখলে ছিল ছোট ছোট দোকানীর, ভোর হতেই সেসব দোকান যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। সবুজ রঙা ইউনিফর্ম পরে মহিলা সাফাইকর্মীর ব্যস্ততা। চোখাচখি হতে মুচকি হাসি। সারি দিয়ে কাঁধেকাধ মিলিয়ে দুই-তিনতলা বাড়ি, নীচের তলাটায় দোকানঘর, ব্যালকনিতে উপচে ওঠা বুগেনভেলিয়া। ফল ফুল মাংস বিক্রেতার ঠেলা গাড়ি। বাড়ির ছাদে, জানালায়, রাস্তায়, গাছ-গাছালিতে লাল পতাকায় হলুদ তারা।

ইলশেগুড়ি বৃষ্টিটা কিন্তু থামছে না। কখন সাতটা বেজে গেছে খেয়াল করিনি। রাস্তায় বসে তন্ময় হয়ে শহর দেখছি। এতক্ষণে বোধ হয় আমাদের ট্যুরিজম এজেন্সি খুলে গেছে। সকাল ৮টায় দেখলাম ব্যঙ্ক খুলে গেছে। ভিয়েতনামে সব কিছুই ভোর ভোর খুলে যায়। দোকানপাট, অফিস কাছারি। তাই পর্যটকদের ব্যস্ততাও সাত সকালেই শুরু হয়ে যায়। ৮.৩০ নাগাদ একটা ছোট লিমৌসিন বাস আমাদের জনা বিশ পর্যটক নিয়ে ছুটে চলল Tuan Chau Harbor এর দিকে। পৌঁছোতে দুপুর হয়ে যাবে। সারা রাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারিনি। বাস Red River এর ওপর দিয়ে দৌড়াচ্ছে। নদীর বিস্তৃত শান্ত রূপের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘুমে তলিয়ে গেছি আর খেয়াল নেই।

ক্রমশ…

One thought on “ভিয়েতনামের ১০ দিন… পর্ব ১

Leave a Reply

Your email address will not be published.