“কাঁঠালি চাঁপা”… বনানী সেনগুপ্ত

  • লেখা – বনানী সেনগুপ্ত
  • অলঙ্করণ – শুভ্রা

-দাদুভাই, দাদুভাই…. চিৎকার করতে করতে দাদুর ঘরে এসে ঢোকে কুসুম।
উমাচরণ বাবু মনোযোগ দিয়ে কিছু ওষুধপত্তর তৈরী করছিলেন। নাতনীর গলার আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে তাকান তিনি।
-কি হয়েছে দিদিভাই? অমন ছুটতে ছুটতে আসছিস যে। উৎকন্ঠীত প্রশ্ন করেন উমাচরণ বাবু।

দাদুভাই, আমার খুব মন খারাপ লাগছে।

সেকি! কেন কেন দিদিভাই? কে তোমায় কি বলেছে, একটু বল তো শুনি।

না না দাদুভাই, কেউ কিচ্ছুটি বলেনি।

তাহলে?
দাদুভাইয়ের খাটে গুছিয়ে বসে কুসুম। উদাস উদাস চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি তো ঘরে বসে মন দিয়ে বৃষ্টি পড়া দেখছিলাম, হঠাৎ ওই চাঁপা ফুলের গাছটার দিকে চোখ পড়তেই মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। বহুকালের কোন পুরোনো কথা, কিসব যেন মনে ভিড় করে আসছিল। কিন্তু সেসব যে কি কথা তা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।

হুমম…. গম্ভীরভাবে বললেন উমাচরণ বাবু। বুঝলি দিদিভাই, আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে। আচ্ছা, এদিকে আয় তো দেখি, লম্বা করে জিভ বের কর।
নাতনী দাদুর আদেশ মতই কাজ করল।

হুমম, এবার চোখটা দেখিতো।
কুসুম বড় বড় করে তাকাল। উমাচরণ বাবু ততোধিক গম্ভীর হয়ে গেলেন।

বুঝলি দিদি, আমার সন্দেহই ঠিক।

কি গো দাদুভাই?

আসলে এমন দিনে তোর নিজের পরীবেলার
কথা মনে পড়ে।

পরীবেলা? সে আবার কি দাদুভাই।
এক গাল হেসে দাদু বলে ওঠেন, তুই যে আসলে পরী ছিলিস রে দিদিভাই।

কি বলছ দাদুভাই? আমি পরী ছিলাম? তবে আমার ডানা কই? পরীদের ডানা থাকে, তারা আকাশে উড়তে পারে, আমি যে পারি না।

এখানে এসে যে তুই মানুষ হয়ে গেছিস। মানুষের কি ওসব থাকলে চলে?
ভারী অবিশ্বাস নিয়ে চোখ দুটো সরু করে চোখের কোনা দিয়ে খানিক্ষন তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে, তাহলে আমি এখানে এলুম কিকরে?

তুই যে ছিলি জলপরী। শরৎকালে পেঁজা তুলোর মত যে মেঘগুলোকে ভাসতে দেখিস আকাশে, জলপরীরা তার ওপর চড়ে ঘুরে বেড়ায়। কখনও কখনও পৃথিবীর কাছাকাছি এলে তারা টুপ্টাপ করে নেমে পড়ে।

কই আমি তো দেখতে পাই নে?

দেখেছিস, চিনতে পারিস নি। তারা কখনও হেমন্তের শিশির হয়ে যায়, কখনও চাঁপা ফুলের রঙ, কখনও হয় ভিজে মাটির সোদা গন্ধ। পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ আহরণ করে আবার তারা ফিরে যায় নিজেদের দেশে।

ও! তাই বুঝি চিনতে পারি নি। তারপর তারপর?

ছোট পরীদের তারা আনে না, পৃথিবীর লোকেরা বড় দুষ্টু, পাছে তাদের আটকে রাখে। তুই তখন ছোট্ট পরী, নাম ছিল তোর কুসুমমালা। গায়ে ছিল চাঁপা ফুলের গন্ধ। তোর পৃথিবী দেখার ভারী ইচ্ছা ছিল, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে চুপি চুপি চড়ে বসেছিলি ছোট্ট মেঘের ভেলায়। তারপর মনের আনন্দে এদিক সেদিক উড়ে উড়ে যাচ্ছিলি নানা দেশের ওপর দিয়ে।

ওমা! কী মজা কী মজা! হাততালি দিয়ে বলে ওঠে কুসুম।

মজা বৈকি দিদিভাই! সে তো দারুণ মজা। কিন্তু তক্ষণি ঘটল অঘটন। হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়া বইতে লাগল, কালো কালো বড় মেঘেরা জটলা করল, একে অপরের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে গর্জন করতে লাগল। তুই তো ছোট্ট পরী, ভয়ে কাঁদছিলি খুব, ঝোড়ো হাওয়ায় তোর মেঘ কোথায় চলে গেল। পথ ফেললি হারিয়ে! এমন সময় একটা কালো মেঘ তোর মেঘটা কে ঘিরে নিল আর অমনি শুরু হল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির জলের সাথে চাঁপা ফুলের গন্ধ হয়ে পৃথিবীর বুকে ঝরে পড়লি টুপ্ করে। আর পড়লি এসে আমাদের বাগানের কাঁঠালি চাঁপা গাছটাতে। তোর মা ছিল ঘুমিয়ে, নাকে গেল সেই সুন্দর গন্ধ। উঠে বাগানে গিয়ে দেখলেন কত চাঁপা ফুল ঝড়ে পড়ে আছে মাটিতে। আঁচল করে তুলে আনলেন ঘরে। খাটে রেখে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ঘুমিয়ে পড়লেন। উঠে দেখেন কোথায় চাঁপা ফুল! কোথায় কি? তাঁর জায়গায় তুই শুয়ে, ছোট্ট একটুখানি কুসুমমালা।

বল কি দাদুভাই? বিস্ময় মেশানো কণ্ঠে বলে ওঠে কুসুম।

হ্যাঁরে দিদি। তাই হয়ত এমন বর্ষার দিনে তোর সেই পরীবেলার কথা মনে পড়ে। কিছুটা আবছা কিছুটা অব্যাক্ত।

কিন্তু দাদুভাই, তুমি এতো কথা কি করে জানলে?

ওমা! আমি যে মাঝে মাঝেই দেখতে পাই, পরীরা তাঁদের সেই ছোট্ট হারিয়ে যাওয়া পরীর খোঁজে পৃথিবীতে আসে, প্রায়ই তোর আশেপাশে ঘোরে। হয়ত তোকে চিনতে পারে না, তুই মানুষ হয়ে গেছিস বলে। এই যে সেদিন বৃষ্টির মধ্যে তুই আর মণি দিদিভাই ইস্কুল থেকে ফিরছিলি আর চারিদিকে জল জমে ছিল, আমি স্পষ্ট দেখলুম ওই জমা জলে, পুকুরের জলে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে যে জল চলকে উঠছিল, সেই জল সাথে সাথে শ্বেত শুভ্র জলপরী হয়ে যাচ্ছিল আর বারে বারে ঘুরে ঘুরে তোকে দেখছিল।

ওমা! তাহলে আমায় আগে কখনও বলনি কেন দাদুভাই?

ভয় পেতাম রে। পাছে তারা কখনও শুনে ফেলে আর তোকে নিয়ে চলে যায়!
মাথা ঝাকিয়ে বলে ওঠে কুসুম, অমনি! নিয়ে গেলেই হল? আমি কি তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারি? আমি কোত্থাও যাব না তোমাদের ফেলে।

বলছিস দিদি, সত্যি সত্যি?

এই তোমার গা ছুঁয়ে তিন সত্যি করছি দাদুভাই, সত্যি সত্যি সত্যি!

Leave a Reply

Your email address will not be published.