ভিয়েতনামের ১০ দিন… পর্ব ২

  • লেখা ও ছবি – সায়ন ভট্টাচার্য

হ্যানয় থেকে Tuan Chau Harbor টানা তিন ঘণ্টার পথ। তাই পথে বিরতির জন্য বাস দাঁড়ালো একটা Pearl Farm এ। ফার্ম না বলে ওয়ার্কশপ বলাই ভালো হবে। বাস থেকে নামতেই একজন গাইড আমাদের দল বেঁধে নিয়ে গেল অন্দরে। কত ধরণের ঝিনুক হয়, সেই ঝিনুক থেকে কি কি রঙের মুক্তো পাওয়া যায়, ঝিনুক চাষের পদ্ধতি, মুক্তো সংগ্রহের পদ্ধতি, সংগৃহীত মুক্তো প্রসেসিং করে গয়না তৈরির পদ্ধতি ইত্যাদি প্রক্রিয়া সামনা সামনি চাক্ষুষ করা গেল এই ওয়ার্কশপে। সঙ্গে রয়েছে ফার্ম থেকে সরাসরি মুক্তো ও গহনা কেনার সুযোগ। হারবারে ঢুকতে এখনও ১ ঘণ্টা লাগবে।

১২টা নাগাদ হারবারে পৌঁছালাম। বিশাল এলাকা জুড়ে অর্ধচক্রাকার হারবার, এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ৪-৫ কিমির মত। একাধিক জেটি। একটু তফাতে চতুর্দিকে ছোট বড় ক্রুজের সমাহার। ২ তারা থেকে ৭ তারা সমস্ত রকমের প্রমোদতরীই বর্তমান। জেটির কাছে জলস্তর কম বলে সেগুলি খানিক তফাতেই রয়েছে। দূরে জলের মধ্যে মধ্যে মাথা উঁচিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে ছোট ছোট পাহাড়। আবছা দেখা যাচ্ছে। আকাশ গোঁসা করে রয়েছে কিনা, দুরে আবছায়ার পর্দা তাই। আমারও খানিক গোঁসা হয়েছে। ভিয়েতনাম ভ্রমণ লিখে গুগল ইঞ্জিনে কয়লা ঢাললেই প্রথম যে ছবি আসবে তা হালং বে’র। আসমানি রঙ জলের মধ্যে উজ্জ্বল সবুজে মোড়া ছোট বড় পাহাড়। আহ! কি ছবি! সেই রং নিয়েইতো এতদিন নিজের স্বপ্ন এঁকেছি। কিন্তু কোথায় সে রং, অবিরাম বৃষ্টির জলে ধুয়ে মেঘলা হয়ে গেছে।  আমাদের একটা বিশ্রাম কক্ষে কিছুটা অপেক্ষা করতে হল। জেটি ঘাটে ঘাটে চরম ব্যস্ততা। দেশ বিদেশের ট্যুরিস্টে ছয়লাপ। রকমারি ট্যুরের আয়োজন আছে এখানে। কেউ দিনের দিন ঘুরে নিতে পারেন, আবার কেউ প্রমোদতরীতে দু-এক রাত কাটাতে পারেন। আমরা বেছে নিয়েছিলাম “দি রয়াল প্যালেস ক্রুজ” -এ এক রাত দুইদিনের প্যাকেজ যাকে বলে। তাতেই আমার নিম্নবিত্ত পকেটের হার্ট ফেল করে করে অবস্থা। কিন্তু এটুকু না করলেই যে নয়।

কিছু পরেই ডাক পড়ল। একটি ছোট মাথা ছাওয়া ভটভটির পেটে ঢুকে গেলাম। সবাইকে লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আমি যতক্ষণে লাইফ জ্যাকেটটি সম্পূর্ণ রূপে মাথায় গলিয়েছি, ততক্ষণে সেটি খুলে ফেলার সময় হয়ে গেছে। দেখি হারবার ছাড়িয়ে ইতিমধ্যেই আমাদের ক্রুজের সামনে চলে এসেছি।  লঞ্চে আহিরিতলা থেকে শোভাবাজার যেতেও এর তিনগুন সময় লাগে। ক্রুজের কর্মীরা হাত নাড়িয়ে উষ্ণ অভিবাদন জানাচ্ছে। ভটভটির কাছি ক্রুজের গায়ে বাঁধা হলে দেখি ঢাক ঢোল পেটাতে শুরু করে দিয়েছে। আমাদের রাজা বাদশা ঠাউরেছে বোধ করি। যুদ্ধ জয়ের পর নতুন রাজাকে সসম্মানে বরণ করে নিচ্ছে সব। আমারও ভাব গতিক পাল্টে গেছে। নবাবী কায়দায় দুহাত বাড়িয়ে দিলাম, ওমনি ক্রুজ থেকে দুজনে দুহাত ধরে আলুর বস্তার মত টেনে তুলে নিল। ব্যাটারা আমেরিকাকে ঠেঙ্গিয়ে পাট পাট করে দিয়েছে যেখানে, কোথায় লাগে সালকিয়ার নবাব। রয়াল প্যালেস ক্রুজটা দারুন। সব মিলিয়ে একদম ভিন্টেজ। প্রথমেই সবার সাথে পরিচয় পর্ব, নানা দেশ থেকে এসে জড়ো হয়েছি সবাই। আমরা ভারতীয় ছাড়াও রয়েছেন আমেরিকা, কানাডা, অস্ত্রেলিয়া, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, সুইতজারল্যান্ড, ইতালি এই সব দেশের বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন মানুষ। এমন অনুভব আগে কোনদিন হয়নি। মনে হচ্ছে অলিম্পিকের আসরে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছি। সবাই এগিয়ে এসে হাসি মুখে সম্ভাষণ জানাচ্ছে, আলাপ করছে, একে অপরের দেশের কথা জানতে চাইছে, ভ্রমণের আগ্রহ প্রকাশ করছে। বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব বোধ তখন তুঙ্গে। পরম সুখ পেয়েছিলাম সেদিন। মনের গোমড়া ভাবটা কেটে গেল নিমেষেই।

ক্রুজে আমাদের গাইউ আল্যান। হাসিখুশি রসিক ছেলে। আমাদের কখন কি করতে হবে বুঝিয়ে দিল ভালো করে। ক্রুজ ততক্ষণে পাড়ি জমিয়েছে হালং বে’র অন্দরে। আমাদের ঘরটা জাহাজবাড়ির দোতলায়, একেবারে পেছন দিকের শেষ প্রান্তে। ঘর থেকে বেরোলেই একফালি বারান্দা। আরাম কেদারা রয়েছে সেখানে। পাশ থেকে একটা লোহার মই বেয়ে উঠলেই তিনতলায় জাহাজের ডেক। দক্ষিণ চীন সাগরের নীলচে জল মিশেছে এই ১৫০০ বর্গকিমি ব্যাপ্ত এই হালং উপসাগরে। চারিদিক ছোট ছোট পাহাড়ে ঘেরা। প্রায় হাজার খানেক পাহাড় আছে এই উপসাগরে যাদের বয়স প্রায় ৫০০ কোটি বছর। পাহাড়ে পাহাড়ে নানা গাছ পালা ফুল পশু পাখি। এখন আর খারাপ লাগছে না। বর্ষায় যেমন দার্জিলিং এর আলদাই রূপ, এও ঠিক তাই। দুরের পাহাড় গুলোর মাথায় মেঘ জমাট বেঁধে আছে। এক একটা পাহাড়ের আকৃতি এক এক রকম। দূর থেকে হয়ত মনে হচ্ছে একটা ব্যাঙ বসে আছে। আরও একটু কাছে এগোতে মনে হতে লাগল কচ্ছপ, আরও কাছে গিয়ে মনে হল ডাইনোসর… এই সব খেলা চলছে। বিশাল পাহাড়গুলোর পাদদেশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কিছুটা শীর্ণ।

দুপুরের খাওয়া দাওয়া এক্কেবারে এলাহি ব্যাপার। হরেকরকম সি ফুড থেকে শুরু করে মুর্গী শুয়োর গরু সব। এছাড়াও নানা রকমের ফল ও ভিয়েতমিজ খাবার। আয়ারল্যান্ডের একজোড়া কপোত কপোতির সঙ্গে জমিয়ে গল্প গুজব করতে করতে সেসব খাবার উদরস্ত করলাম। তাঁরা দেখলাম সি ফুড পছন্দ করেন না, অতএব ওঁদের ভাগের ঝিনুক আর স্কুইডগুলো আমার পেটেই… এভাবেই ভ্রাতৃত্ব বোধের নজির তৈরি হল। খাওয়া দাওয়া সেরে একটু স্টিকি ভাত ঘুম দেব ভেবেছিলাম। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে রয়েছি কিনা। কিন্তু আল্যানের হাঁকডাকে আর সেই সুযোগ মিলল না। আমদের এখন কায়াকিং এর জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। আবার সবাই জড়ো হলাম একতলায়। আবার সেই ভটভটি এবং সেই লাইফ জ্যাকেট। এবার আর মাথায় গলাতে হয়নি। হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে সোজা উল্টো ঠিক করতে করতেই ভটভটি ভিড়ল আবার এক Pearl Farm এ। এটা সত্যিই ফার্ম। হালং বে’র মধ্যে ভাসমান। বিশাল এলাকা নিয়ে ঝিনুক চাষ চলছে। এখানেও গাইড রয়েছে সব কিছু ঘুরিয়ে দেখানোর। তবে আমরা সরাসরি এগিয়ে যাই কায়াকিং করতে। ওই পার্ল ফার্মের পেছনেই একটি ভাসমান জেটিতে সার দিয়ে কায়াক রাখা। আবার লাইফ জ্যাকেট পরিধান পর্ব মিটিয়ে, প্যাডেল সংগ্রহ করে, চড়ে বসলাম একটি কায়াকে। শান্ত জলে ভাসতে ভাসতে চারিদিকের পাহাড়ের খাঁজে কে কোথায় মিলিয়ে যেতে থাকলাম। একঘণ্টা পর আবার ফিরে চলা। পরের গন্ত্যব্য Titov Island. হালং বে’র যেকটি পাহাড়ে পর্যটকের পা ফেলার অনুমতি আছে, সেগুলির মধ্যে অন্যতম এই টি টভ আইল্যান্ড।  নামতেই সামনে একটি ছোট্ট বীচ। আল্যান একটা ফুটবল নিয়ে মেতে উঠল খেলায়। সামনে ক্যাফেটেরিয়া। তার পাশে এক প্রস্তর ফলকে এই দ্বীপভূমির ইতিহাস। রাশিয়ান মহাকাশচারি Gherman Titov (ইউরি গ্যাগরিনের পরে ইনিই দ্বিতীয় ব্যাক্তি যিনি ভস্তক-২ চেপে মহাকাশে গিয়ে পৃথিবী প্রদক্ষিন করেছিলেন) এখানে এসেছিলেন বলে স্বয়ং হো চি মিন এই নামকরণ করেন। বাঁধানো সিঁড়ি খাড়া উঠে গেছে পাহাড়ের মাথায়। সামান্য পরিসরে ওঠা নামা করতে হচ্ছে বলে একটু সময় সাপেক্ষ। একদম চুড়োয় পৌছাতেই সবাই নির্বাক। এই ছবিইতো গত ছয়মাস ধরে দেখে এসেছি। পাখির চোখে দিগিন্ত বিস্তৃত হালং উপসাগর। নীল সবুজের গালিচা যদিও এখন ধুসর রঙা। রংবাহারি জাহাজ ভেসে বেড়াচ্ছে। ওই পাহাড়গুলোর জন্যেই উপসাগরের রূপ এমন খোলতাই হয়েছে। এত অল্পে মন ভরে না, কিন্তু আলো কমে আসছে… অগত্যা।

জাহাজে ফিরে স্নান সেরে সবাই জড়ো হয়েছে নৈশভোজের টেবিলে। আল্যান বলে চলেছে ৭.০০ টায় নৈশভোজ, ৮টায় সবাই মিলে জাহাজের ডেকে নাচাগানা, ৯টায় রাতের অন্ধকারে হালং বে’র জলে স্কুইড ফিশিং। মনে মনে ভাবছি ওরে আমাকে রেহাই দে এযাত্রায়। দুদিন ধরে চোখে ঘুম নেই। আর আমাকে ঘুমের থেকে দূরে রাখা যাবে না ভাই। তাই রাতের খাবার পর্ব জলদি শেষ করে, বেয়াড়া কুমড়োর স্যুপ খাওয়ার ফলে স্বাদ কোরকের উপর অন্যায় অবিচারের কথা ভাবতে ভাবতে ঘরের সামনের আরাম কেদারায় এলিয়ে গেলাম। সামনেই অন্ধকারে জমাট পাহাড়। নাচ গানের শব্দ আর পাইনি। হয়ত সবাই আমার মতই শ্রান্ত ছিল। শুধু ছিপে করে স্কুইড ধরার আনন্দের সীমা ছিল না কয়েকজনের।

আল্যান বলে রেখেছিল যে “তাই চি”- যা কিনা একরকম যোগ ব্যায়াম, ক্লাস হবে পরদিন ভোরে। ঘুম ভাঙতে জানলার পর্দা সরিয়ে দেখি বৃষ্টি পড়ছে। চারিদিক ধোঁয়া ধোঁয়া। নিকুচি করেছে তাই চি, ঘুম সাগরে তখনও ক্রুজ বাইছি। আরও খানিক পরে উঠে এলাম বাইরে। ঐ বললাম ধোঁয়া ধোঁয়া, ওগুলোতো কুয়াশা। চারপাশ ছেয়ে রয়েছে। পাহাড় থেকে পাহাড়ে বিস্তৃত হয়ে আছে ঐ ধোঁয়ার কুণ্ডলী, সেসব পেরিয়ে চলেছে আমাদের জাহাজ। ফিরতি পথ। ঠাণ্ডা হাওয়ায় চোখে মুখে বৃষ্টির ফোঁটা উড়ে আসছে। আবারও সেই আরাম কেদারা। কিছুক্ষন পরেই তো আবার শহরে ফিরে যেতে হবে ভাবলেই মনটা ভার হয়ে আসে। আল্যান বলেছিল যে জলখাবারের পরে কোন এক গুহায় নিয়ে যাবে, কিন্তু নাহ। মন চাইছে এভাবেই আরও কিছু পল একলা কাটিয়ে দিতে। তাই আল্যান যখন অন্যদের নিয়ে রওনা হল, আমি টাটা করে দিলাম। আরাম কেদারাই বটে। ছেড়ে যাওয়ার বিষাদের মধ্যে একটুকু আরাম তোলা থাক সারাজীবনের জন্য।

ক্রমশ…

Leave a Reply

Your email address will not be published.