গল্প – ২

হঠাৎ বিশ্রী একটানা একটা শোরগোলে ঘুমটা ভেঙে গেল। স্মার্ট ওয়াচটায় মাত্র সাতটা কুড়ি বাজে দেখে মটকা আরও গরম হয়ে গেল শতানীকের। কাল শুতে শুতে প্রায় সাড়ে তিনটে বেজে গেছিল। কাজের চাপ বাড়তে বাড়তে অফিস ছেড়ে এখন বাড়ি অবধি তাড়া করে এসে গেছে, যদিও কিছু বলার নেই। সেসব শেষ করে অত দেরিতে শুয়ে আবার যদি এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যায় মেজাজের আর দোষ কী? আর শোরগোল তো এ বাড়িতে নতুন না। একতলায় মা আর গৌরীদি সকাল হলে যেন মল্লযুদ্ধ শুরু করে। তার সাথে যোগ্য সঙ্গত দিতে থাকে ঠিকে ঝি দিদি আর দুনিয়ার ফেরিওয়ালারা। সেসবই চলছে নিশ্চয়ই। বিরক্তির সাথে মাথার বালিশটাই নিয়ে কানে চাপা দিল শতানীক। যদিও ইতর বিশেষ কিছুই হল না। এবার কে যেন দরজা ধাক্কাচ্ছে! দুর্বাসা মুনি টুনিরা কেন শাপ দিয়ে মানুষকে পোকামাকড় বানিয়ে দিত বেশ বোঝা যাচ্ছে এখন। কিন্তু সে উপায় না থাকার অক্ষমতায় নিজের উপর যথেষ্ট আফসোস হতে লাগলো। এবার দরজা ধাক্কানোর সাথে বাবার গলা!

বুক্কা, এই বুক্কা, শুনছিস?

এটা তো অদ্ভুত ব্যাপার! বাবা নিজে দোতলায় উঠে এসে এই সকালে ডাকনামে ডাকছে! যে বাবা হাঁটু অপরেশনের পর গত দেড় বছর যাবত দোতলায় ওঠে না! নাঃ আর শুয়ে থাকা সম্ভব না। এক লাফে বিছানা থেকে নেমে দরজাটা খুলে দিল শতানীক। বাবা দাঁড়িয়ে।

শিগগির মুখে চোখে জল দিয়ে নিচে আয়। খুব দরকার।

কেন বাবা! মা ঠিক আছে?

যথেষ্ট ঘাবড়ে গিয়েই প্রশ্নটা করে বসল শতানীক।

না না সেসব না। পাশের বাড়িতে নির্মলদা দরজা খুলছেন না। সকাল থেকে অনেক ডাকাডাকি করা হচ্ছে।

মানে নির্মল জেঠু! কেন?

জানিনা গিয়ে দেখ দেখি কি ব্যাপার।

এক দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো শতানীক।

আধা পশ আধা কলোনি এ পাড়াটার পুরনো বাসিন্দাদের মধ্যে যে কটি পরিবার এখনো রয়ে গেছে নির্মল জেঠু তাদের অন্যতম। পাড়ার একজন স্তম্ভ বিশেষ। সদাহাস্যজ্বল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অজাতশত্রু মানুষটি ছোট বড় সকলেরই প্রিয়। পুরো নাম নির্মলেন্দু দত্তগুপ্ত। ছোট থেকে কিশোর বয়েস অবধি শতানীক ছাড়া পাড়ার আরও বহু বাচ্ছার গল্প শোনার আবদার মেটাতেন নির্মল জেঠু। বিভিন্ন আগ্নেয়গিরির গল্প, দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের মাংসাশী গাছের গল্প, বিভিন্ন প্রাচীন জনজাতির গল্প সবকিছু বড় সহজ ভাবে শোনাতেন জেঠু। নির্মল জেঠুর দৌলতেই সেই ছোট্টবেলাতেই শতানীক সহ এ পাড়ার অনেক ছোটরাই স্কুলের সিলেবাসের বাইরে গিয়ে শুনে ফেলেছিল ভিসুবিয়াসের নাম। জেনে ফেলেছিল মাংসাশী গাছের দুটি প্রজাতি আম্লতা এবং কাঁতলবুট, ঢিল ছোঁড়া দুরত্ব সুন্দরবনেই অবস্থান করে। পরিচিত হয়ে গেছিল এই দেশ সহ পৃথিরীর প্রাচীনতম বাসিন্দা সেন্টেনাল দ্বীপের বাসিন্দাদের সাথে। আজ যে সব কাজকর্ম করে বর্তে খাচ্ছে, তার পেছনে নির্মল জেঠুর অবদান অনেক।

লেকগার্ডেন্স অঞ্চলে জেঠুদের বাড়িটা তিনতলা। জেঠিমা মারা যাওয়ার পর একতলাটা ভাড়া দিয়ে দোতলা এবং তিন তলা নিয়েই জেঠু বাস করতেন। এর মধ্যে তিনতলা একটা অংশ জুড়ে স্টাডিরুম এবং লাইব্রেরি। অন্য দিকটায় দুটো ঘর নিয়ে জেঠুর থাকার ব্যবস্থা। আর দোতলার একটা অংশে রান্না ঘর আর সাথে লাগোয়া ঘরটায় জেঠুর একমাত্র সঙ্গী সত্যানন্দ ওরফে গদাইদা থাকে। জেঠুর একমাত্র মেয়ে অলি দি, যার ভালো নাম নয়নিকা, এলে অন্য অংশের ফ্ল্যাটটায় থাকে। না হলে তালা বন্ধ অবস্থাতেই রাখা থাকে। প্রায় বছর দশেকের বড় অলিদি দুর্দান্ত স্টুডেন্ট ছিল। তার সাথে আরও মারাত্মকভাবে ডানপিটে। কলেজ জীবন থেকেই ট্রেকিং থেকে রক ক্লাইম্বিং সব কিছুতেই যাওয়ার অভ্যাস। জেঠুও খুব উৎসাহ দিত যদিও জেঠিমার এসব নিয়ে অনেক ক্ষোভ আপত্তি ছিল। কিন্তু সেসবে কে আর পাত্তা দেয়। নিজের মতে নিজের ইচ্ছাতেই সব সময় চলতে অভ্যস্ত অলিদি। চেনা ছকের বাইরে যেতেই সব সময় পছন্দ করে এসেছে। না হলে যাদবপুরের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেয়ে মাস কয়েক ক্লাস করেও শুধু রাঁধতে ভালবাসে বলে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়তে ঢোকে কেউ? এরপর জেঠিমা মারা যাওয়ার পর আজ বছর পাঁচেক অলিদি চাকরি নিয়ে জাপানে আছে।

কোনওরকমে জামাটা গায়ে গলাতে গলাতেই ছুটে জেঠুর বাড়ির দরজায় গিয়ে পৌছাল শতানীক। নিচে এ পাড়ারই পরিচিত লোকজনদের নিয়ে ছোটখাটো একটা ভিড় এর মধ্যেই হয়ে গেছে। তাদের মাঝখান দিয়ে রাস্তা করে নিয়ে দ্রত তিনতলায় উঠে এল সে। জেঠুর দরজার সামনে বছর পঞ্চাশের গদাইদা পা ছড়িয়ে হতবাক মুখে বসে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আরও জনা সাতেক লোক। গদাইদাকে জিজ্ঞেস করে যা জানা গেল, কালীপূজোতে বরাবরের মতই লক্ষীকান্তপুর লাইনের মাধবপুরে ভাইপোর বাড়িতে গেছিল গত পরশু। তারপর ভোরের ট্রেন ধরে আজ সকালে ফেরে। ডুপ্লিকেট চাবি নিজের কাছেই থাকে। তা দিয়ে খুলে ঢুকে দেখে চিরকাল সাড়ে পাঁচটায় উঠে পরা জেঠু সাড়ে ছটাতেও নিজের ঘরের দরজা খোলেনি। এরপর অনেক ডাকাডাকি এবং দরজা ধাক্কাধাক্কিতেও জেঠু কোনো সাড়াশব্দই করছেনা দেখে নিচে গিয়ে এক তলার ভাড়াটে ছেলে দু-জনকে জানায়। আর তাদেরই একজন ধীমান জানায় বুক্কাদের বাড়িতে। অলিদির অবর্তমানে শতানীকই এবাড়ির অলিখিত গার্জিয়ান এটা পাড়ার মোটামুটি সবাই জানে।

এতজন তোমরা জড়ো হয়ে কাওতালি করছো এতক্ষণ ধরে, কিন্তু দরজাটা ভেঙে ঢুকতে পারলে না!

কিছুটা বিরক্তি থেকেই কথাগুলো গদাইদার দিকে তাকিয়ে বললেও আসলে বলল ভিড়ের উদ্দেশ্যে।

পুরনো দিনের সেগুন কাঠের দরজা, দু তিনজন মিলে ধাক্কা দিয়ে, শাবল দিয়ে চাড় দিয়ে খুলতেও বেশ বেগ পেতে হল। ঘরের ভিতরটা বহুবার আসার সুবাদে চেনা এবং জানা। ডান দিকের টেবিলটার উপরে কাঁচের একটা জলের জাগ আর একটা গ্লাস। সাথে এদিক ওদিক ছড়ানো গোটা পাঁচেক বই আর একটা ডেস্কটপ কম্পুটার। সেটার পরে ওপাশে খাটের উপর জেঠু আড়াআড়ি ভাবে শুয়ে আছে, পা মাটিতে। বাম হাত বুকে অন্য হাতে খামচে ধরে আছে বিছানার চাদর। দু চোখ আধবোজা। কিছুটা খোলা মুখ দেখে মনে হচ্ছে প্রবল শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল তাই মুখ দিয়ে শ্বাস নেবার চেষ্টা করছিলেন। সাধারণ চোখেই বোঝা যাচ্ছে প্রাণ নেই।

কাকাবাবু! এটা কি হল!

চিৎকার করে কেঁদে উঠল গদাইদা। নিজেদের সন্তানের থেকে কোন অংশে কম কিছু ছিল না গদাইদা এই বাড়িতে। সেই কোন ছোট্ট বেলায় অনাথ হয়ে যাওয়া গদাইদা আশ্রয় পেয়েছিল জেঠু-জেঠিমার কাছে। তারপর এখানেই অক্ষর পরিচয় থেকে একদম মাধ্যমিক অবধি পড়াশোনা। দুজনেই আরও পড়াতে চেয়েছিলেন কিন্তু গদাইদাই আর রাজি হয়নি পড়তে। পড়াশোনার চেয়েও কিছুটা আত্মভোলা মানুষটার আগ্রহ বরাবরই হাতের কাজের দিকে। ছোটবেলা থেকে কৈশোরের একটা বড় সময়- পাড়ার সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেল, ঝুলনে সাজানো, ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া কোনোকিছুতেই গদাইদা ছাড়া চলত না শতানীক আর তার বন্ধুদের।

খাটে শুয়ে থাকা দীর্ঘদেহী মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অজান্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে এল শতানীকের। এত জানা এত চেনা মানুষটি নিমেষে না থাকার জগতে নাম লেখাল! জীবন কত অনিশ্চিত! পেশাগত কারণেই মৃতদেহ ঘাঁটতে হয়। কিন্তু অজানা অচেনা মানুষ আর নির্মল জেঠু তো এক নন। প্রায় আশি ছুঁইছুঁই বয়েস হয়েছিল, এই বয়েসে মৃত্যু অনভিপ্রেত কিছু নয়। তবে মারা যাওয়ার আগে বেশ কষ্ট পেয়েছেন খানিকক্ষণ, সেটা উপলব্ধি করে মনটা বড় ভারি হয়ে উঠছিল। আপাতত হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া সহ আরও আনুষঙ্গিক কাজকর্ম আছে।

বুক্কা, এটা কি হল ভাই!

ডাক শুনে সম্বিত ফিরল। পাপ্পা, পাড়ার ছোটবেলাকার বন্ধু। খবর পেয়ে এসেছে।

সবাইকে খবর দে। জেঠু আর নেই।

পাঁজাকোলা করে জেঠুকে তুলে খাটে ভাল করে শোওয়াতে শোওয়াতে কথাগুলো বলল শতানীক। আর বলতে বলতেই চোখ চলে গেল হাঁ হয়ে থাকা মুখটার দিকে। জিভটা অস্বাভাবিক ভাবে বেঁকে উপরের পাটির কষের দাঁতের সাথে যেন গেঁথে গেছে। অদ্ভুত তো! জোরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলে জিভের পজিশান এমন হবে কেন! তবে কি জিভ অসাড় হয়ে গেছিল? সেরিব্রাল এট্যাকে এমন হতে পারে। তবুও কোথাও যেন কিন্তু একটা থেকেই যাচ্ছে! আবেগ ইমোশান ছাপিয়ে ক্রমশ শতানীকের মস্তিষ্কের দখল নিচ্ছে গভর্মেন্ট ইনস্টিটিউট অব ফরেন্সিক সায়েন্স নাগপুরের প্রাক্তন ছাত্র এবং বর্তমান সি আই ডির দায়িত্বশীল ক্রাইম সিন ইনভেস্টিগেটর। মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল শতানীক।

– এই ঘরে কোন কিছুতে হাত দিও না কেউ। সবাই বাইরে চলো ঘর আটকানো থাক পুলিশকে খবর দিতে হবে।

ঘরে আর বারান্দায় এক সাথে বাজ পড়লো যেন। খানিক স্তব্ধতার পর পাপ্পা বলল কি হয়েছে রে! কিছু সন্দেহজনক লাগছে?

মাথা নেড়ে সম্মতি সূচক সাড়া দেওয়ার পাশাপাশি তীক্ষ্ণ চোখে জেঠুর দেহটা লক্ষ্য করে যাচ্ছিল শতানীক। নাহ আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না বাইরে থেকে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসা অবধি অপেক্ষা করতেই হবে।

সময় থেমে থাকে না। কেটে গেছে আরও দেড়টা দিন। প্রাথমিক ঝড়ের সবটা অর্থাৎ থানা পুলিশের হ্যাপা থেকে হাসপাতাল সবটা শতানীককেই সামলাতে হয়েছে। যেহেতু কাজের সূত্রে ঐ সব মহলে অল্প বিস্তর চেনাজানা হয়েছে সেগুলো কাজে লেগে গেল এই সময়। আপাতত জেঠুর দেহ পিস ওয়ার্ল্ডে রাখা আছে। অলিদি আর ওর বয়ফ্রেন্ড ওসাকা থেকে রওনা হয়ে গেছে। ওরা এসে পৌছালে বাকি আর যা কিছু কাজ। আপাতত ক্লান্ত শরীরে মুখ গুঁজে ছিল বিছানায়। ফোন সাইলেন্টে রাখা। যা কিছু কল আসছে ঘড়িতে দেখেই কেটে দিয়েছে। রিসিভ করেছে যে কটা না করলেই নয়। আবার কল এসেছে।

বিরক্তি নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল শতানীক। নামটা দেখেই নিমেষে সচল হয়ে উঠল মস্তিষ্কের সমস্ত নার্ভ, স্বপনীল।

জেঠুর অটপ্সির দায়িত্বে এই ছেলেটিই ছিল। নাগপুরে কলেজে ওর থেকে দু ব্যাচ জুনিয়র। সেই তখন থেকেই পরিচয়। শতানীক বলে রেখেছিল জেঠুর স্টমাক এবং লিভার আলাদা গুরুত্বের সাথে পরীক্ষা করে দেখতে এবং জানাতে।

– দাদা, তুমি যা সন্দেহ করেছিলে সেটাই।

– মানে!

— It’s a case of poisoning. ভদ্রলোকের মৃত্যু হয়েছে বিষের কারণেই। তবে আসল কথা শুনলে তুমি চমকে যাবে।

কি কথা?

এইটা যেহেতু টক্সিক কেস। স্বাভাবিকভাবেই আমি ওনার বডি অর্গান সহ কেস ডিটেইলস টক্সিকোলজি ডিপার্টমেন্টে ট্রান্সফার করি, মানে যেটা নিয়ম আর কি। সেখান থেকে এক্ষুনি আমায় জানাল যে ওনার শরীরে ‘টেট্রোডোটক্সিন’ পাওয়া গেছে। ভাবতে পারছ? তবে এসব কথা অবশ্য তোমায় আনঅফিসিয়ালি জানাচ্ছি। স্টমাক আর লিভার আরও ভাল করে দেখে তারপর অফিসিয়াল রিপোর্ট তৈরি হবে তখন আরও অনেক কিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে।

— টেট্রোডোটক্সিনটা আবার কি জাতীয় বিষ রে?

— এই TTX বা Tetrodotoxin is at least 1000 times more toxic than potassium cyanide. আরে দাদা তুমি তো জানো পাশ করে বেরিয়ে টক্সিকোলজিস্ট হিসেবেই প্রথমে বছর খানেক ঘষেছিলাম। বিভিন্ন পয়জন নিয়েই তখন পড়া লেখা করতে হয়েছিল যে। তখনই জেনেছিলাম TTX কি ডেঞ্জার জিনিস।

ফোনেই যথেষ্ট উত্তেজিত লাগছে স্বপ্নকে।

কি বলছিস!

আরে আমিও তো রিপোর্ট দেখে হতবাক হয়ে গেছি। এই বিষ ইন্ডিয়ার কারোর হাতে আসারই কথা না! কিছু কেমিস্ট, কিছু ল্যাব তাও যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য কারণ দেখিয়ে, স্পেশাল পারমিশন করিয়ে, তবে হাতে পায়।

খুব অবাক করলি রে স্বপ্ন।

অবাক তো তোমরা করলে আমায়। খোদ কলকাতায় একটা মানুষ TTX এর প্রভাবে মরে যাচ্ছে। একটা মানুষ সামান্য এক mg TTX এর প্রভাবেই এক মিনিটের মধ্যে মরে যেতে পারে। সেখানে প্রায় .5 mg TTX পাওয়া গেছে স্টমাকে! ভালো করে তদন্ত করতে বলো পুলিশকে।

মাথা ফাথা পুরো ঘেঁটে দিয়ে ফোনটা কেটে দিল স্বপ্ননীল। অন্যমনস্ক ভাবেই একটা সিগারেট ধরিয়ে জোরে টান দিল শতানীক। মাথায় ভিড় করে আসছে বর্তমান আর অতীতের হাজারো স্মৃতির কোলাজ।

বাবার কাছেই শুনেছে ওপার বাংলার কিশোরগঞ্জের মানুষ ডাকাবুকো নির্মল জেঠু দেশ ছেড়েছিলেন ৭১ এর যুদ্ধের সময়। তখন উনি প্রায় বছর পঁচিশের তরুণ। আর্থিকভাবে যথেষ্ট স্বচ্ছল পরিবারের মেধাবী ছেলে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে রাজাকার এবং খানসেনাদের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন স্বাভাবিকভাবেই। ওখানকার গুরুদয়াল কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাশ করা জেঠু প্রায়শই গর্ব করে বলতেন – “জানিস আমাদের কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ তৈরি হয়েছিল প্রফেসর সত্যেন বোসের উৎসাহ আর তত্ত্বাবধানে”।

দেবব্রত বিশ্বাসের গানের অন্ধভক্ত মানুষটিকে বাবা এবং বয়স্ক লোকজন ক্ষ্যাপাতো – ‘যতটা না তুমি ওনাকে গান শুনে ভালোবাসো তারচেয়ে বড় কারণ জর্জদা আমাগো কিশোরগঞ্জের পোলা বইল্যা’। মুখে কিছু না বলে মিটিমিটি হাসত জেঠু। অথচ সেই বাবাকেই দেখেছে জেঠুর সাথে বসে “প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে” শুনতে শুনতে আকুল হয়ে চোখ ভাসাতে। বিশেষ করে “আরও বেদনা আরও বেদনা, প্রভু দাও মোরে আরও চেতনা” বলে যাবতীয় আকুলতা মিশিয়ে জর্জ বিশ্বাসের সাথে জেঠুও যখন গেয়ে উঠতেন; কতবার ঘরে বসা জেঠিমা সহ আরও বিভিন্ন জনের সাথে ছোট্ট শতানীকেরও চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। গলার ভিতরে দলা পাকানো অদ্ভুত এক কষ্ট অনুভব করত। উফ কি সব ছোটবেলা কাটিয়ে এসেছে। হুড়মুড়িয়ে নানা স্মৃতি বর্ষাপুষ্ট পাহাড়ি নদীর মত দুকূল ছাপিয়ে ভেসে আসছে যেন।

বাবাও খুব ভেঙে পড়েছে। নিজের দাদার চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না মানুষটা বাবার কাছেও। যেকোন জরুরি পরামর্শ করতে বাবা দৌড়াত নিমুদার কাছেই। শতানীকের ফরেন্সিক সায়েন্স নিয়ে পড়তে নাগপুর যাওয়া নিয়ে মায়ের বহু আপত্তি ছিল। সেই মাকে শেষ মেশ বুঝিয়ে রাজি করায় নির্মল জেঠুই।

এই লেকগার্ডেন্স অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে প্রায় বছর পঞ্চাশ কাটিয়েও দেশ বলতে জেঠু বাংলাদেশকেই বুঝত। বাইপাসের ধারের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা করাতে আসা বাংলাদেশী বহু মানুষের বিনামূল্যের আশ্রয়স্থল জেঠুর এক তলার দুটো ঘর। পরিচিত, স্বল্প পরিচিত এমনকি অপরিচিতও কত লোক যে এই ঘরগুলোতে এসে থাকে। নির্মল জেঠুকে পাড়ায় বিভিন্নরকম সামাজিক কাজে সবসময় অগ্রণী ভূমিকা নিতে সেই ছোট্টবেলা থেকেই দেখে অভ্যস্ত শতানীক সহ আরও অনেকেই। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই অফিস করেছে, আরও অন্যান্য যা কিছু করেছে সে। আপাতত রাত আটটা। ঘরে ফিরে ল্যাপটপ খুলে বসে কিছু জরুরি মেল পাঠাচ্ছিল, ফোনে স্বপ্ননীলের নাম ভেসে উঠল। সচকিত ভাবে রিসিভ করল শতানীক।

– বুক্কা দা, ভদ্রলোকের রিপোর্ট সব পেয়ে গেছি। স্টমাকে পাফার ফিসের স্যাম্পল পাওয়া গেছে। মারা যাওয়ার আগে উনি ওটাই খেয়েছিলেন। আর সেটাই ওনার মৃত্যুর কারণ। তোমার সাথে কাল একবার সামনাসামনি বসে কথা বলতে পারলে ভালো হয়।

– কাল সন্ধ্যার দিকে গ্রিন প্যালেসে চলে আয়। ভবানীপুরে একটা কাজ আছে, সেটা সেরে নিয়ে তাহলে আমার যেতে সুবিধা হবে।

এখন রাত সাড়ে দশটা। রাতে দাঁত ব্রাশ না করে শেষ কবে শুয়েছে শতানীকের মনে পরে না। কিন্তু আজ ইচ্ছেই করছে না। মাথাটা ঝিম মেরে আছে। কারণটা এন্টিকুইটির চার পেগ নাকি স্বপ্ননীলের বলা কথাগুলো? কে জানে! কোনওমতে জামা আর প্যান্টটুকু খুলে জাঙ্গিয়া পরা অবস্থাতেই বিছানায় গড়িয়ে পরল সে। অথচ চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই। রগের কাছটা এখন দপদপ করছে। এসব কি শুনিয়ে গেল স্বপ্ন।

জাপানের ডিলিসিয়াস একটা ডিসের নাম ফুগু। যা ঐ পাফার ফিস দিয়ে তৈরি হয়। অথচ দুনিয়ার সবচেয়ে বিষাক্ত প্রাণীর একটা হল নাকি এই পাফার ফিস। এদের স্কিন এবং বিশেষ করে লিভারে থাকে TTX. আবার সেই লিভারই নাকি সবচেয়ে সুস্বাদু খাদ্য। তাই ভোজন রসিকদের রসনা মেটাতে অভিজ্ঞ এবং তিন বছরের এই সংক্রান্ত বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শেফ ছাড়া ফুগু ডিস রান্নার অনুমতিই দেয় না জাপান সরকার। সবচেয়ে বড় কথা কিছু স্টার ক্যাটাগরির হোটেল রেস্টুরেন্টে ছাড়া ফুগু নাকি পাওয়াই যায় না। অথচ সেই খাবার খেয়ে মানুষটা কলকাতায় মরে গেল! বা বলা ভাল কেউ মেরে দিল!

লেক থানা থেকে জেঠুর ঘর সিল করেছে সেদিনই। ঘরের মধ্যে টেবিলে থাকা জলের জাগ, গ্লাস সবকিছুই সিজ করে ফরেন্সিক টেস্টে পাঠানো হয়েছে কিন্তু সেখানে TTX পাওয়া যায়নি। এটা বোঝাই যাচ্ছে যে কালীপূজোর সময়, খাদ্য রসিক মানুষটাকে নিতাইদার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে এসে কেউ ঐ ভয়াবহ বিষ মেশানো খাবার খাইয়েছে, তারপর খাওয়া হয়ে গেলে থালা বাসন সমস্ত গুটিয়ে নিয়ে দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এটা জেঠুর খুব চেনা কেউ ছাড়া আর অন্য কেউ করতে পারে না। কে সে? মোটিভ কি তার? বিভিন্নধরনের সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত থাকায় কত রকমের মানুষের যে আনাগোনা ছিল বাড়িটায়। তার মধ্যে কে এই কাজ করল?

তারপর ? গল্পটা শেষ করতে হবে আপনাকে ? লিখে ফেলুন আর পাঠিয়েদিন আমাদের। আমরা আপনাদের লেখার অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published.