“কাটলেট”

  • লেখা- চম্পক সাহা
  • অলঙ্করণ- শুভ্রা

ডাউন দুন-হাওড়া এক্সপ্রেস সবেমাত্র একুশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে পৌঁছেছে। মৌমাছির চাকের মতো  জেনারেল কম্পার্টমেন্টে গাদাগাদি করে বসে থাকা যাত্রীরা একে একে তাদের ক্লান্ত শরীরগুলোকে টেনে বের করে আনছে প্ল্যাটফর্মে। কয়েকটা কামরা পেরোতেই এসি টু-টায়ার। ঢাউশ লাগেজ হাতে, হাসিমুখে প্ল্যাটফর্মে পদার্পণকারী সেই কামরার  প্রত্যেক অভিযাত্রীর অভিব্যক্তিতে ঝরে পড়ছে আভিজাত্যের আতিশয্য। সমুদ্রমন্থনের প্রথম অমৃতটাকে ভগবান যেন সযত্নে লেপে দিয়েছেন ওদের উজ্জ্বল ত্বকে। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছুঁতে না ছুঁতেই, এক অদ্ভূত কৌশলে নিজেদের মলিন দেহ দু’টোকে এসি টু-টায়ারের সেভেন-বি কামরাতে গলিয়ে দিল রাধু আর মুনিয়া। কামরা খালি হবার পূর্বেই ওদের অনুপ্রবেশ ঘটল সুখের সেই স্বর্গরাজ্যে। 

এই রাধু আর মুনিয়া হল বছর আটেকের ফুটফুটে দু’টো বাচ্ছা মেয়ে। ঠিকানা- কেয়ার অফ ফুটপাথ। পাঁচ বছর বয়স থেকেই নিজেদের পেটের জোগাড়ে ব্যস্ত ওরা দু’জন। পথচলতি বাবুদের কাছে পাওয়া ভিক্ষা আর কুকুরের সাথে লড়াই করে রাস্তার ডাস্টবিন থেকে সংগ্রহ করা উচ্ছিষ্ট খাবারই ওদের একমাত্র উপজীব্য। তবে উপরির আশায় মাঝেমধ্যেই ওরা পা বাড়ায় দূরপাল্লার এক্সপ্রেস ট্রেনের বিলাসবহুল কামরায়। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকার সাথে সাথেই উসেইন বোল্টের দ্রুততায় কম্পার্টমেন্টে সেঁধিয়ে দেয় শুষ্ক শরীরগুলোকে। তারপর গোটা কামরা জুড়ে চলে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল , খাবারের প্যাকেট আর অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের খোঁজে চিরুনি তল্লাশি। সেখান থেকে প্রাপ্ত ময়লার পুঁটুলি কাঁধে ছুটে যাওয়া বড়বাজারে। ভাঙাচোরায় সব বিক্রি করে যৎসামান্য যা জোটে আর কি! মাঝেসাঝে প্ল্যাটফর্মের পুলিশকাকুগুলো হঠাৎ এসে বাজে ভঙ্গিতে আদর করে ওদের, জোর করে পকেট থেকে বের করে নেয় টাকা। নিরীহ বাচ্ছা দু’টোর চোখের জলও, নির্মম- পুলিশের বিবেক সাফে অপ্রতুল যে।

তবে রাধুর কপালটা আজ বেশ ভালো। বিলাসবহুল কম্পার্টমেন্টের ডাস্টবিনে হাত ঢুকিয়ে একটা কাগজে মোড়া নেতানো ফ্রাই পেয়েছে ও। মুনিয়া বললো, ওটাকে নাকি বড়লোকরা ‘কাকলেট’ বলে , কাকের মাথা ফাথা দিয়ে বানায় হয়তো; ওর অনেকদিনের শখ যে একবার চেখে দেখবে। রাধুর ডানহাতে নোংরার ঝোলা আর বাঁ হাতে ‘কাকলেট’। প্ল্যাটফর্মে লাফিয়ে নামতেই নজর গেল হেলতে দুলতে এগিয়ে আসা ভুঁড়িওয়ালা এক পুলিশকাকুর দিকে। নিজেদের আড়াল করতে রাধু আর মুনিয়া উল্টোদিকের রেললাইনে দিল প্রাণপণ ঝাঁপ। দু’হাতেই জিনিস থাকায় ভারসাম্য রাখতে ব্যর্থ হল রাধু। ডাউন ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ছিন্নভিন্ন করে দিল ওর লিকলিকে শরীরটাকে।  অপরদিকে পড়ে আছে মুনিয়ার ঠান্ডা  ‘কাকলেট’;  ততোধিক ঠান্ডা ওর নিষ্পাপ কাটা  মুন্ডুটাকে ঘিরে কলতান তুলেছে একদল কালো কাক। 

Leave a Reply

Your email address will not be published.