ইচ্ছেমতো-র নাটক “কিত্তনখোলা”

  • সমালোচক – সায়ন ভট্টাচার্য
  • ছবি – সংগৃহীত

মেলা মানেই এক মহা-মিলনের উৎসব। গ্রামের অনাড়ম্বর শান্ত জীবনে, মেলা একরাশ উৎসাহ , উদ্দীপনা ও বিনোদন। “কিত্তনখোলা” নদীর পাশে ফি-বছর এই মেলা বসে। আপনারাও কি এই কিত্তনখোলার মেলায় পৌঁছে যেতে চান? তাহলে অবশ্যই দেখতে হবে “ইচ্ছেমতো” প্রযোজিত নাটক- “কিত্তনখোলা”। মূল নাটক – সেলিম আল দীন, পরিচালনায়- সৌরভ পালোধী, সঙ্গীতে- দেবদীপ মুখার্জী।

মেলাই এই নাটকের পটভূমিকা। মেলায় এসেছে যাত্রা দল। দলের মূল আকর্ষণ- ‘বনশ্রীবালা’। সাধারণ দর্শক মাত্রই সামনে থেকে একটিবার দেখতে চায় বনশ্রীবালাকে। আর তাকে কাছে পেতে চায়- মেলার আয়জক ‘ইদু’, যে কিনা এলাকার হত্তা-কত্তা। ইদুর কথায় ওঠে বসে দলের মাস্টার ‘সুবল’, সে চায় বনশ্রীকে ইদুর ঘরে পাঠাতে। এ-বিষয়েই তীব্র আপত্তি দলের প্রধান অভিনেতা ‘রবি দাসের’, যাকে ভালবাসে বনশ্রী। রবি দাসও কি তাহলে বনশ্রীকে… ? অন্যদিকে গ্রামের একজন সোজা শিরদাঁড়ার মানুষ- ‘সোনাই’, যার পৈতৃক একটুকরো জমি ছলে-বলে ছিনিয়ে নিতে চায় ইদু। নির্ভীক সোনাই প্রতিবারেই ফিরিয়ে দেয়। অথচ সোনাই প্রেমে পড়ে নীচু জাতের ‘ডালিমনের’। তাদের এই মেলামেশাকে ভালো চোখে দেখে না দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। এই সব ঘটনার মধ্যে দিয়েই পরিণতির দিকে এগোতে থাকে নাটক। শেষে কি অবস্থা হয় বনশ্রীর কিংবা সোনাইয়ের? সে আগ্রহ নিরসন করতে হলে দেখে আসুন “কিত্তনখোলা”।

সাধারণকে সাধারণ ভাবে পরিবেশন করতে যে অসাধারণ দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে, ইচ্ছেমতো সেই দক্ষতার সঙ্গেই নাটকটি পরিবেশন করেছে; জিতে নিয়েছে দর্শকদের ভালবাসা ও মুগ্ধতা। পরিচালক ও অভিনেতারা ছুঁতে পেরেছেন অন্ধকারে বসা সামনের মানুষগুলোকে। মঞ্চসজ্জা (অপ্রতিম সরকার ও সৌরভ পালোধী) ও আলো (সৌমেন চক্রবর্তী) ছিল যথাযথ। ফালি ফালি কাপড়ের পর্দায় প্রোজেক্টরের সাহায্যে গ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতে মন চলে যাচ্ছিল কিত্তনখোলার পাড়ে। তবুও কোথাও যেন মন চাইছিল পর্দায় প্রকৃত মেলার ভিড়, দোকানপাট, পসরা, খানাপিনা, নাগরদোলা ইত্যাদির চেনা ছবি খুঁজে পেতে। মঞ্চে আকর্ষণীয় লেগেছে বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা দুটি চোঙ। কিত্তনখোলা নাটক আদ্যপান্ত সঙ্গীতময়, দেবদীপ মুখার্জীর সঙ্গীত এই নাটকের প্রাণ। আচ্ছা! ঐ চোঙ দুটিও যদি সঙ্গীত পরিবেশন করে কেমন হয়? শুধুমাত্র এই নাটকের সঙ্গীত নিয়েই আলাদা শো হতে পারে। আহেলী সরকারের কণ্ঠের গান অসাধারণ; শুভাশিস খামারু কণ্ঠ দিয়ে নাট্যমুহুর্তকে তুলে দিচ্ছিলেন অনন্য উচ্চতায়। লোক-সঙ্গীতের আরও অন্যান্য ঘরানা নাটকে স্থান পেলে আরও বৈচিত্রপূর্ণ হতে পারত। প্রতিটি অভিনেতাই অসাধারণ। ইদু চরিত্রে- শঙ্কর দেবনাথ, বনশ্রীবালা- সুচরিতা মান্না, রবি দাস- অনুজয় চট্টোপাধ্যায়; এঁদের অভিনয় মাতিয়ে রেখেছিল সারাক্ষণ। অসাধারণ লেগেছে ‘ছায়া রঞ্জন’ চরিত্রে- শান্তনু মণ্ডলকে। আর যাদের কথা না বললেই নয়- ‘মালেক’ – প্রসূন সোম, ‘বসির’- শুভঙ্কর হালদার, ‘ননীবালা’ – ঋ ত্বিকা নাথ; কি অপূর্ব দক্ষতায় এনারা সাধারণ থেকে অতি-সাধারণ মুহূর্তগুলি তৈরি করেছেন, যে দৃশ্যগুলি মনে গেঁথে রয়েছে। হয়ত থাকবেও চির তরে। তবে, প্রায় প্রতিটি চরিত্রের বিভিন্ন মুহূর্তে, বেরিয়ে যাওয়ার সময় থমকে থেমে পেছন ঘুরে একবার দেখে তারপরে বেরিয়ে যাওয়ার টেকনিকটি দৃষ্টিকটু লেগেছে বারংবার পুনরাবৃত্তি হওয়ার ফলে। নদী ধারে বনশ্রীবালার ছোটবেলা, ইদুর ঘরে নাচের আসর, মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া- ইত্যাদি দৃশ্যগুলির দৃশ্যায়ন অপূর্ব।

কানায় কানায় ভর্তি পেক্ষা গৃহ এবং মুহুর্মুহু দর্শকদের হাততালিই প্রমাণ দেয় দর্শকদের হৃদয়ে কিত্তনখোলার জায়গা কতখানি। নাটক মানেই সবসময় আলাদা করে ভারী কিছু চাপিয়ে দেওয়া নয়। প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তার বাইরেও নাটক হয়। নরম মাটির- নরম নাটক, যা আপনার-আমার চারপাশের সাধারণ জীবনের ছবি তুলে ধরে। হাসায়-কাঁদায়-ভাবায়। এ নাটক ঠিক তাই। মেলা ভেঙে যাওয়ার পর তাই আবার অপেক্ষা। আবার অপেক্ষা পৌঁছে যাওয়ার- “কিত্তনখোলার” পাড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.