নাটক – দুর্গা দুর্গতিনাশিনী

  • রচনা – পারিজাত ব্যানার্জী
  • অলঙ্করণ – শুভ্রা

(চারজন দুর্গা, চারজনই দিনশেষে ক্লান্ত বিধ্বস্ত পাশাপাশি বসে মেট্রোরেলের কামরায়। টিমটিম করে এসি চলছে বটে, তবে চারজনের গলার মুখের ঘাম তাতে কিছুতেই শুকাচ্ছে না। চারজনই দুর্গা ঠিকই কিন্তু তাদের এই নামটুকু ছাড়া আর মিল নেই কোথাও। এক দুর্গার আদি বাড়ি পটনায়। কর্মসূত্রে কলকাতায় এক মেসবাড়িতে তার বাস। অবিবাহিত। বছর চল্লিশ বয়স। আরেক দুর্গার পঁচিশ মত। এর মধ্যেই বিয়ে-থা করে ঘোরতর সংসারী; এক সন্তানের জননীও। তৃতীয় দুর্গা কলেজে পড়ে। স্বপ্ন দেখে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার। আর চতুর্থ জন বৃদ্ধা; সদ্য হারিয়েছেন যিনি তাঁর স্বামীকে।)

দুর্গা এক – (আপন মনে) ধুর কলকাতায় নাকি পাটনার থেকে কম গরম! কে বলবে! পুজো এসে গেল, গরমের তবু কমতি হল না!

দুর্গা দুই – (হেসে) কি করে আর কমবে দিদি? কথায় তো আছে, ‘ভাদ্রের পচা গরম’।

দুর্গা তিন – এই জন্যই আমি স্টেটস-এ যেতে চাই। আই জাস্ট হেট গ্রীষ্মকাল!

দুর্গা চার – (আপনমনে) পালানো কি এত সোজা রে মা, আমিও তো পালাতে চাই। পারি আর কই?

দুর্গা দুই – সে কি দিদা পালাবে কেন? ও কথা বলতে নেই। (দুর্গা তিনের দিকে তাকিয়ে) আচ্ছা মেয়ে তো তুই! এসব কথা কেউ বলে এখানে? জানিস তো সবই!

দুর্গা তিন – (অবাক হয়ে) আমি আবার কি করলাম? আমি তো এক দেশ থেকে আরেক দেশে পালানোর কথা বললাম। থোরাই না বৈতরণী পার করার কথা বলেছি!

দুর্গা চার – (বিব্রত হয়ে) আরে না না আমিও, হ্যাঁ আমিও তো ওই গরমের কথাই বলছিলাম।

দুর্গা এক – মাসিমা, দুঃখকে চাপলে কিন্তু বাড়ে জানো তো! আর আমরা তো তোমার আপনজন। আমাদের সবার যে এক নাম সূত্রে সম্পর্ক। দুর্গা দুর্গতিনাশিনী! তাই নিজেদের দুর্গতি নিজেরা সামলাবো না আগে!

দুর্গা তিন – দুর্গা দুর্গতিনাশিনী তো নয়, আমার নাম দুর্গা মজুমদার। আর তোমাদের একজন ভৌমিক, একজন বসু আর একজন ভট্টাচার্য!

দুর্গা দুই – উফ বাবা এইতো ক বছরই ছোট হবি তুই আমার থেকে, এর মধ্যেই সব বোধ বুদ্ধি কি লোপ পেয়ে গেল সমাজের? ‘দুর্গতিনাশিনী’ পদবী নয়। পরিচয়। আমরা সব মেয়েরাই মায়ের অংশ যে, তাই। বুঝলি?

দুর্গা এক – একদম মনের কথা বলে দিলি রে বোন! নাহ, তোরা আছিস বলেই প্যাচপ্যাচে গরম সহ্য করেও তোদের এই কলকাতায় পড়ে আছি আমি। নয়ত একা জীবনটা পানসে হয়ে যেত রে পুরো!

দুর্গা চার – এবার একটা বিয়ে করেই নাও না মা। অনেক তো হল স্বাধীনভাবে থাকা। এবার একটু না হয় বাঁধনে জড়াও। সম্পর্ক কতদিন থাকে পরে দিনশেষে, সেটা বড় কথা নয়। জীবন চলার ক্লান্তিকর পথে অন্তত কেউ আমার সঙ্গী ছিল এই ভাবনাটাই খুব দামি।

দুর্গা তিন – কিন্তু সবার জীবন তো খুব আলাদা গো দিদা। এক ক্যানভাসে একরকমভাবে তাদের সব রঙ কি ধরা যায়? এই যে দুর্গাদি-বর বাচ্চা নিয়ে সংসার করছে তোমাদেরই মত বাড়ির বড়দের কারও কথা শুনে, সেও কি আদৌ সুখী? সব থেকেও তো সে একাই। বর তো কাজের সূত্রে বাইরে বাইরেই থাকে – ভুলেও আর বউয়ের দিকে তাকায় না।

দুর্গা দুই – না না ফোন করে তো! খোঁজ খবর নেয় ছেলের।

দুর্গা এক – আর তোমার?

(সবাই চুপ হয়ে যায় কয়েক মুহূর্তের জন্য)

দুর্গা এক – (দুর্গা তিনের দিকে তাকিয়ে) তুই ভাই বয়সে ছোট হতে পারিস, মাঝে মাঝে অদ্ভুত কথাও বলিস; তবে বোকা নোস রে একদমই। কার জীবনে কি আছে; কেন রয়েছে; কে কি পায়নি; পেলে কেমন হত – এসব কথাগুলোর সত্যিই কোনও মানে হয় না আর। (দুর্গা চারের হাত ধরে) আসলে কি জানো তো মাসিমা – সবাইকে তাদের যুদ্ধটা তাদের মত করে একাই লড়তে হয়। দুর্গা ঠাকুরের মূর্তির দিকে তাকিয়ে খেয়াল করেছ কখনো? সেখানেও তার সঙ্গী মাথার ওপর শিব ঠাকুরের ছবি হিসেবে ঝোলে ঠিকই বা ছেলে-মেয়েগুলো টুক করে যুদ্ধ শেষে পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে দিব্যি; কিন্তু আসল লড়াইটা লড়তে হয় সেই দুর্গাকেই। অর্থাৎ আমাদেরই!

দুর্গা দুই – ঠিক বলেছ দিদি। সব কাজে ভুলেই নিজেদের পরিচয়টুকু অন্তত আমাদের ভুললে চলবে না কিছুতেই। (কি যেন মনে পড়ায়) আচ্ছা দিদা তুমি তোমাদের বাড়ির নিচের তলাটা খালি করে এবার থেকে পুজো শুরু করবে বলেছিলে না; তার কত দূর?

দুর্গা তিন – ওয়াও বাড়ির পুজো! হাউ নস্টালজিক! হ্যাঁ প্লিজ দিদা, করো করো! জমে যাবে একদম!

দুর্গা চার – সেরকমই তো ভেবেছিলাম কিন্তু উনি চলে গেলেন। আমি একা বুড়ি মানুষ। পারব কি সব?

দুর্গা দুই – একা কই দিদা? আমরা আছি তো! এই না দিদি বলল, আমরাই আসল দুর্গা! তাহলে আমাদের অসাধ্য আর কি?

দুর্গা চার – তোরা তাহলে করবি আমার সাথে পুজো? সত্যি?

সবাই একসঙ্গে – একদম সত্যি!
দুর্গা এক – আমি লোক লস্কর জোগাড়ের দিকটা দেখছি তবে।

দুর্গা দুই – আর আমি পুজোর সব আয়োজন হাতে হাতে করব তোমার।

দুর্গা তিন – তবে সবার আগে ঠাকুর লাগবে তো! কুমোরটুলিতে শেষ বেলায় পাওয়া কিন্তু চাপ। আমার এক বন্ধু আর্ট কলেজে পড়ে ওকে বলছি বরং। ওরা কয়েকজন মিলে যদি এ প্রজেক্টটা উৎরে দেয়! আচ্ছা, বাকি কথা কাল হবে ঠিক আছে দিদা? আমার স্টপ এসে গেল, উঠলাম। টাটা!

দুর্গা দুই – আমারও। আজ তাহলে আসি! মনে রেখ কিন্তু- আমরা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী!

দুর্গা এক – হয়েছে হয়েছে। সাবধানে যা এবার বাড়ি দুটোয়!

দুর্গা চার– সত্যি, আজ এই বুড়িটাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিলি রে তোরা! দেখে শুনে যাস কেমন! দুগ্গা দুগ্গা!

Leave a Reply

Your email address will not be published.