“নীল মাধব”…. অনুপম দাস

  • লেখা- অনুপম দাস
  • ছবি- সংগৃহীত

কলকাতার ই-এম বাইপাসে এক চিলতে জমির উপর ডক্টর শ্যামল রায়ের ছোট্ট আই ক্লিনিক। ডক্টর রায়ের ক্লিনিকের ঢিল ছোড়া দূরত্বে একটি ভারত বিখ্যাত আই হসপিটালের শাখা, তার সুবিশাল কলেবর নিয়ে ডক্টর রায়ের ক্লিনিককে বিদ্রুপ করছে যেন। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চাঁদের হাট। আর ডক্টর রায়ের চেম্বারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডক্টর রায় একম-অদ্বিতীয়ম, তবু অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ সম্পূর্ণ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বহুতলে উন্নতমানের চিকিৎসার প্রতিশ্রুতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, দলে দলে রোগী ডক্টর রায়ের ক্লিনিকে ভিড় করেন। সপ্তাহে, যে তিন দিন ডক্টর রায় পেশেন্ট দেখেন সেই দিনগুলোতে সকাল আটটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত তার ক্লিনিকে তিল ধারনের জায়গাটুকু থাকে না।

ডক্টর রায় তার পেশেন্টদের টাকা উপার্জনের যন্ত্র মনে করেন না। মন দিয়ে তাদের কথা শোনেন, আর কথায় কথায় হরেক রকম টেস্ট বা অপারেশনের নিদান দেন না। একবার এক গরীব ভদ্রলোক একরাশ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে ডক্টর রায়কে এসে বললেন, “আমায় বাঁচান ডাক্তার বাবু”। তিন মাসের মধ্যে, কুড়ি হাজার টাকা করে মোট তিনটি ইঞ্জেকশন না দিলে তার বাঁ চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ নিভে যাবে, এমন ফরমান জারি করেছে কলকাতারই নামকরা কোন নেত্রালয়। ভদ্রলোকের চোখ ভালো করে পরীক্ষা করে ডক্টর রায় হাসলেন। সেই হাসির মধ্যেই যেন অনেকটা আশ্বাস মিশেছিল। ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে বললেন, “কি দেখলেন ডাক্তারবাবু, ইনজেকশন নেওয়া ছাড়া কিছুই কি করার নেই”? ডক্টর রায় বললেন, “চোখে ইনজেকশন নেওয়া অনেক কষ্টের বুঝলেন, তার থেকে হাতে সুচ ফুটিয়ে ইনসুলিন নিয়ে আগে আপনার সুগারটা কন্ট্রোল করুন। তারপর আপনি যদি সুগার কন্ট্রোলে রাখতে পারেন তাহলে আর চোখে ব্যথা করার দরকার নেই। ভদ্রলোক ডক্টর রায়ের চেম্বারে বিষন্ন মুখে ঢুকেছিলেন, মিনিট দশেক পরে যখন বেরিয়ে এলেন তখন তার মুখে প্রশান্তির হাসি আর চোখে যেন নতুন করে আলো জ্বলে উঠেছে।

সেদিন হঠাৎ করেই একটা জরুরী কাজ এসে যাওয়ায় ডক্টর রায় কে বেলা বারোটার মধ্যে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। বাইরে যেসব পেশেন্টরা অপেক্ষা করছিলেন তাদের কাছে মার্জনা চেয়ে ডক্টর রায় তাদের সেদিনকার মত ফিরে যেতে বললেন। এক বৃদ্ধা কাতর সরে বললেন, “আমি অনেক দূর থেকে এসে সেই সকাল থেকে বসে আছি বাবা, একটিবার দেখে দেবে না”?! বৃদ্ধার অনুরোধ কিছুতেই এড়াতে পারলেন না ডক্টর রায়। তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে। ডক্টর রায় পরীক্ষা করে বললেন, “আপনার দুটো চোখেই ছানি পড়েছে, অপারেশন করে নিলেই মা আপনার দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে যাবে”। “সত্যি বলছ বাবা! ছানি অপারেশন করলেই আমার দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে যাবে”?! উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞেস করলেন বৃদ্ধা। “আপনার চোখে আর কোন সমস্যা নেই মা, শুধু এই ছানিটা অপারেশন করে কন্টাক্ট লেন্স বসিয়ে দিলেই আপনি দুটো চোখে পরিষ্কার দেখতে পাবেন”। শান্ত স্বরে বললেন ডক্টর রায়। বৃদ্ধা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আনন্দে ডক্টর রায়ের দুটো হাত চেপে ধরলেন। তার দু-চোখ ভিজে উঠেছে আনন্দাশ্রুতে।

“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাবা আমার চোখ অপারেশনের ব্যবস্থা কর। অপারেশনের পর আমি যদি স্বচ্ছ দৃষ্টি পাই তাহলে তো আমার নীলমাধবকে দেখতে পাবো”। বৃদ্ধা যেন মনে মনে পৌছে গেছেন সব পেয়েছির দেশে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.