আত্ম-চেতনায় দীপ্তিময়ী হেলেন কেলার

  • লেখা- অনুপম দাস
  • ছবি – ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

বিশ্ব প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ অনুভব করার জন্য আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় আছে। এর মধ্যে যদি কোন একটি বিকল হয় তাহলে জীবনে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আর কারোর যদি একই সঙ্গে একাধিক জ্ঞানেন্দ্রিয় বিকল হয় তাহলে তার কাছে জীবন আক্ষরিক অর্থে অমাবস্যা রাত্রির মতই অন্ধকার। কিন্তু মার্কিন মহীয়সী নারী হেলেন কেলার ছিলেন বিশ্বের মুষ্টিমেয় বিরল কিংবদন্তীদের একজন, যিনি একই সঙ্গে দৃষ্টিহীন ও বধির হওয়া সত্তেও দীপাবলির মতই আলোকোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।

জীবনের মাত্র ১৯ মাস বয়সে ছোট্ট হেলেন এক জটিল অসুখের শিকার হয়ে অন্ধকার এবং নৈশব্দ লোকের অধিবাসী হয়ে পরে। সেই কৃষ্ণ-গহ্বর থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ওঠার  ইতিহাস আমরা জানি। এই স্বল্প পরিসরের রচনায় আমরা দেখব  গভীর সৌন্দর্য বোধ ও মানব প্রেমের আদর্শ কিভাবে তাঁর জীবন যুদ্ধে সহায়ক হয়ে, এই জগতের আনন্দ যজ্ঞে তাকে সামিল করেছে।

একটা সনাতন অন্ধ বিশ্বাস আছে, প্রতিবন্ধকতা পূর্ব জন্মের পাপের ফল। আমাদের দেশেই যে শুধু এ বিশ্বাস প্রচলিত আছে এমন নয়, পশ্চিমী দুনিয়ার মানুষদেরও এই বিশ্বাস লালন করতে দেখা যায়। বাইবেলের সেন্ট জনের গশপেলে উল্লেখ আছে যিশু খ্রীষ্টের শিষ্যরা একবার এক দৃষ্টিহীন মানুষকে দেখে প্রভুকে প্রশ্ন করে, এই ব্যক্তিটির দৃষ্টিহীন হবার কারণ কী? পূর্ব জন্মের পাপের ফল, নাকি এর বাবা মায়ের কর্মফল? শিষ্যদের  প্রশ্নের উত্তরে প্রভু যিশু বলেন, এই ব্যক্তি দৃষ্টিহীন হয়ে জন্মেছে কারোর পাপের ফলে নয়, ঈশ্বরের কর্মকে পরিষ্ফুট করবার জন্যই সে দৃষ্টিহীন। পরিতাপের বিষয় প্রশ্ন কর্তাদের ওই প্রশ্নটাই পৃথিবীর মানুষের মনে আজও বদ্ধমূল ধারণা হয়ে রয়ে গেল। যিশু খ্রীষ্টের উত্তরটা প্রচারের আলো পেল না। হেলেন কেলার সে কথা মনে রেখেছিলেন, তাই তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ছিল যে ঈশ্বর কোন মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তাকে পাহাড় প্রমান প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন করেছেন। ভাবলে অবাক হতে হয়, শৈশব থেকে দৃষ্টিহীন ও বধির হওয়া সত্ত্বেও হেলেনের সৌন্দর্য বোধ সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশি ছিল। পৃথিবীর সৌন্দর্য তিনি যেভাবে সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করতেন তা একমাত্র সূক্ষ অনুভূতি সম্পন্ন মানুষের পক্ষেই সম্ভব।

তাঁর বহির জগতের সৌন্দর্য উপলব্ধি সম্পর্কে হেলেন কেলার একটি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। নীল আকাশের নিচে, ঝলমলে রোদ্দুরে যখন গাছের ডালে বসেই পাখিরা কলতান তোলে, বাতাসের ছোঁয়া লেগে পাতায় পাতায় আনন্দ চাঞ্চল্যের ঢেউ ওঠে, তখন মাটির তলায় গভীর অন্ধকারে যে শিকড় গুলি রয়েছে তারাও তো সেই আনন্দে অংশগ্রহণ করে।সেই ভাবেই তিনি অন্তরের আলোকে পৃথিবীর সৌন্দর্য অনুভব করেন, পাখির কলতান শোনেন হৃদয় দিয়ে। আসলে তাঁর অক্ষম ইন্দ্রিয়ের  রুদ্ধ সংবেদনশীলতা পুঞ্জীভূত হয়েছে বাকি ইন্দ্রিয় গুলোর মধ্যে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে , মাঝে মাঝে মনে হয় যেন দেহের রক্ত-মাংসের সমস্ত শক্তি গিয়ে কেন্দ্রীভূত হয় দৃষ্টিশক্তি রূপে, আর তার মধ্য দিয়েই প্রকৃতির বিচিত্র রূপ সম্ভার প্রতিফলিত হয় তার মানসপটে। তাঁর সৌন্দর্য চেতনার জন্য তাঁর শিক্ষয়িত্রীর সৌন্দর্য প্রীতির ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। তাঁর বর্ণনার সঙ্গে কল্পনার রঙ মিশিয়ে হেলেন প্রকৃতিকে দেখতে শিখেছেন। আর সেই সঙ্গে ১৯ মাস বয়স পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবন-যাপনের অভিজ্ঞতা তাঁর অবচেতন মনে কাজ করেছে।

মহাকবি মিল্টন দৃষ্টিহীনতার জন্য আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, দৃষ্টি শক্তি শুধু দুটি চক্ষুকোঠোরে আবদ্ধ করে না রেখে, বিধাতা কেন সেই শক্তি দেহের সমস্ত অঙ্গপ্রতঙ্গে সঞ্চারিত করে দেননি? হেলেনের কিন্তু এমন আক্ষেপ ছিল না বরং তাঁর স্পর্শ ইন্দ্রিয়ের সংবেদনশীলতা এত প্রবল ছিল যে তিনি বলেন এর বিনিময়ে বিধাতা যদি তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে চান তবে তিনি তা প্রতাখ্যান করবেন। তাঁর অন্তর যে ইতিবাচক ভাবনায় জাড়িত ছিল, তা তাঁর  বাহ্য রূপের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সাহিত্যিক মরিস মেটারলিঙ্কের স্ত্রী জর্জেট মেটারলিঙ্ক হেলেনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বিষ্মিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছেন যে, একজন অন্ধ বধির মেয়েকে দেখতে যাচ্ছি বলে স্বভাবতই একটা সমবেদনার ভাব মনের মধ্যে জেগে ওঠে, মনটা একটু বিষাদগ্রস্ত হয়, কিন্তু যখন তিনি দরজা খুলে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন তাঁকে দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অন্ধকারের যবনিকা ভেদ করে যে আলো তাঁর মুখ থেকে ঠিকরে এসে পরছে, তাতে আমার মনের সমবেদনা লজ্জায় মুখ ঢেকে পালিয়ে গেল। তাঁকে দেখে একই মত প্রকাশ করেছেন আরো অনেকেই।

হেলেন কেলার বিশ্বাস করতেন আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় ছাড়াও একটা ষষ্ঠইন্দ্রিয় আছে, যার তিনি নাম দিয়েছেন, “soul-sense বা আত্মিক চেতনা। আর এই আত্ম-চেতনা দিয়েই তিনি সৌন্দর্য অনুভব করতেন। “The world I leave in”, “Out of the dark”, “The song Of The stone wall” এই বই গুলিতে তাঁর সৌন্দর্য চেতনা এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর অনুভূতির তফাত কোথায় তার বিষাদ বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে।

তাঁর নৈসর্গিক সৌন্দর্য চেতনা ছিল চক্ষুষ্মান মানুষের মতই চিত্র-রূপময়।তিনি বলছেন যে, চাঁদনি রাতে নৌকা করে বেড়াতে আমার ভালো লাগে। আমার মুখে এই কথা শুনে হয়ত অনেকেই হাসবেন, কিন্তু এ আমার অনুভূতির কথা। যখন ঝাউ বনের পিছন থেকে আকাশে চাঁদ ওঠে, তা আমি দেখতে পাই না বটে, কিন্তু আমি যখন জলে আঙুল ডুবিয়ে নৌকর উপর শুয়ে থাকি আর ছোট ছোট ঢেউ গুলি খেলা করে আঙুলের ভিতর দিয়ে বয়ে যায়, তখন আমার সত্যই মনে হয় আমি চন্দ্রিমার কম্পমান আঁচলখানি হাত দিয়ে ধরে আছি। একজন দৃষ্টিহীন মানুষের এই সৌন্দর্য বোধ কি বাস্তবে সম্ভব? সমালোচকদের প্রশ্নের উত্তরে হেলেন জানিয়েছেন, কেন এরা মনে করেন যে অন্ধত্ব ও বধিরতা সৌন্দর্যের জগৎ থেকে আমাদের সম্পূর্ণরূপে নির্বাসিত করে দিয়েছে? একেবারে কোন সৌন্দর্য বোধই আমাদের নেই। আকাশের নীলিমা, চাঁদের আলো, পাখির গান এসবের উল্লেখ করে যদি অন্ধ-বধিররা সত্যিকার আনন্দ পায়, তবে তাতেও কি তারা বাধা দেবেন? একি ইন্দ্রিয়ের অধিকার প্রসূত দাম্ভিকতা নয়? যখন মনের অবাধ গতি, ও তার সুদূর প্রসারি ক্ষমতা সম্পর্কে পণ্ডিতদের জ্ঞান এখনো অনেকাংশেই সীমায়িত তখন মননশীলতা দ্বারা সৌন্দর্যের জগতে কতটা প্রবেশ করা যায়, কি কি উপলব্ধি করা যায় এই সব বিষয়ে যদি কেউ নিশ্চিতভাবে অভিমত প্রকাশ করে বসেন তাহলে খুব আশ্চর্য মনে হয় নাকি? এই ভাবে  হেলেন তার যুক্তিনীষ্ঠ অনুভূতি সম্পর্কে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

আশাবাদী হেলেন কেলার জীবনে দুঃখের নৈরাশ্যকে কখনো স্থান দেননি। শত বাধা সত্তেও তার কাছে জীবন আনন্দময়। আনন্দ, নিরলস কর্মব্যস্ততা আর মানব সেবা এই তিনটি আদর্শ কে সঙ্গী করেই গতিশীল ছন্দে তাঁর যাপিত জীবন বয়ে চলেছিল। তাঁর প্রতিবন্ধকতার জন্য তাঁর মনে কি কখনো দুঃখের মেঘ জমে না? এই প্রশ্নের উত্তরে হেলেন বলেছেন যে কখনো যে দুঃখ হয় না তা বলতে পারি না, তবে সে ক্ষণিকের জন্য। হঠাৎ এক দমকা হাওয়া যখন ফুলের বাগানে এসে লুটোপুটি খায়,ফুল গুলি চঞ্চল হয়ে ওঠে। নিমেষের মধ্যে দমকা হাওয়া পার হয়ে যায়, ফুলগুলি শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমারও সেই অবস্থা। হেলেন কেলার দুঃখবাদী নন, কিন্তু তিনি দুঃখকে জীবনে যোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন। তাঁর মতে দুঃখ আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে, তবে তাই বলে সুখকে অবহেলা করা উচিত নয়। তাই নিজের জীবনে যখন দুঃখের ঝড় এসেছে তাকে তিনি সহজাত আনন্দে বরণ করে নিয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিমেষ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তের মালা জপে জপে যেমন মহাকালের সৃষ্টি, তেমনি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সুখের সমষ্টি থেকে আনন্দের বন্যা আসে জীবনে।

 দীর্ঘ ৮৮ বছর হেলেন জীবিত ছিলেন। মৃত্যুকে বহুবার খুব কাছ থেকে দেখেছেন। এমনকি তাঁর শিক্ষয়ত্রী, যিনি তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন তিনিও একদিন কালের নিয়মে তার প্রিয় শিষ্যা হেলেনকে ছেড়ে চলে গেলেন। এই মৃত্যুতে প্রাথমিকভাবে মুষড়ে পরলেও হেলেন সেই শোক জয় করতে পেরেছিলেন। তাঁর প্রত্যয়ী মননে এই বিশ্বাস দৃঢ় ছিল যে মৃত্যুতেই জীবনের শেষ নয়। তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, “Life and death are one in the presence of Lord.”

সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হলেও হেলেন কেলার ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। তবে তা আচার সর্বস্ব সাম্প্রদায়িকতা নয়, আমাদের জ্ঞানের অতীত এক অনন্ত শক্তিকেই তিনি ঈশ্বর বলে মনে করতেন। তিনি মানবতার ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তাঁর সমগ্র জীবন মানব কল্যাণের আদর্শে নিয়োজিত করেছেন।তাঁর ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় তাঁর লেখা, “My religion” বইটিতে। পাহাড় প্রমাণ প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সমগ্র জীবনে হেলেন কেলার যেভাবে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বার বার বলেছেন আমি তোমাদেরি লোক। সারা বিশ্বে হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র এমনটা বলতে পারেন। হেলেন কেলার আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় এজন্য নয়, যে তিনি দৃষ্টিহীন ও বধির হওয়া সত্তেও প্রচুর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবন ও সেই জীবনে অসংখ্য মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য তিনি মানব সভ্যতার ইতিহাসে চির-স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.