কথা না সুর, কে কার অলংকার ?

  • কলমে- অনুপম দাস
  • ছবি – ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ কোন একটি নিদিষ্ট ভাবনায় আজীবন নিজেকে বেঁধে রাখেননি, তাই কোন একটি বিষয়ে একদিন যা বলেছেন পরবর্তী সময়ে সেই বিষয়েই সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। এই পরস্পর বিরোধিতা আপাত ভাবে অসংগত মনে হলেও, রবীন্দ্রনাথের মননকে অনুধাবন করে দেখি তাঁর চিন্তা জগতে স্থবিরতা ছিলনা। তাই সংগত কারণেই তাঁর ভাবনাও ছিল পরিবর্তনশীল। কোন একটা নিদিষ্ট ভাবনার গণ্ডিতে নিজেকে বেঁধে রাখার মানুষ তো তিনি ছিলেন না। তাই, “হেথা নয় অন্য কোথা, অন্য কোন খানে”। এই চরৈবেতির মন্ত্র কে শিরোধার্য করে বিশ্ব পথিক রবীন্দ্রনাথ জীবনের পথে হেঁটেছেন।

“জীবন স্মৃতি”র “গান সমন্ধে প্রবন্ধে” রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “দ্বিতীয়বার বিলাতে যাইবার পূর্বদিন সায়াহ্নে বেথুন- সোসাইটির আমন্ত্রণে মেডিকাল কলেজ হলে আমি প্রবন্ধ পাঠ করিয়াছিলাম। প্রবন্ধের বিষয় ছিল সংগীত। যন্ত্রসংগীতের কথা ছাড়িয়া দিয়া আমি গেয় সংগীত সম্বন্ধে ইহাই বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম যে, গানের কথাকেই গানের সুরের দ্বারা পরিস্ফুট করিয়া তোলা এই শ্রেণীর সংগীতের মুখ্য উদ্দেশ্য। আমার প্রবন্ধে লিখিত অংশ অল্পই ছিল। আমি দৃষ্টান্ত দ্বারা বক্তব্যটিকে সমর্থনের চেষ্টায় প্রায় আগাগোড়াই নানাপ্রকার সুর দিয়া নানাভাবের গান গাহিয়াছিলাম। কিন্তু যে মতটিকে তখন এত স্পর্ধার সঙ্গে ব্যক্ত করিয়াছিলাম সে মতটি যে সত্য নয়, সে কথা আজ স্বীকার করিব। গীতিকলার নিজেরই একটি বিশেষ প্রকৃতি ও বিশেষ কাজ আছে। গানে যখন কথা থাকে তখন কথার উচিত হয় না সেই সুযোগে গানকে ছাড়াইয়া যাওয়া, সেখানে সে গানেরই বাহনমাত্র। গান নিজেরই ঐশ্বর্যেই বড়- বাক্যের দাসত্ব সে কেন করিতে যাইবে। বাক্য যেখানে শেষ হইয়াছে সেইখানেই গানের আরম্ভ। যেখানে অনির্বচনীয় সেইখানেই গানের প্রভাব। বাক্য যাহা বলিতে পারে না গান তাহাই বলে। এইজন্য গানের কথাগুলিতে কথার উপদ্রব যতই কম থাকে ততই ভালো।“

রবীন্দ্রনাথের গান মূলতঃ বাণী প্রধান হলেও সংগীতে সুরের এক অনির্বচনীয় শক্তির কথা তিনি স্বীকার করেছেন এপ্রসঙ্গে “জীবন স্মৃতি”র, “গান সমন্ধে প্রবন্ধে” রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “রাগিণী যেখানে শুদ্ধমাত্র স্বররূপেই আমাদের চিত্তকে অপরূপ ভাবে জাগ্রত করিতে পারে সেইখানেই সংগীতের উৎকর্ষ। কিন্তু বাংলাদেশে বহুকাল হইতে কথারই আধিপত্য এত বেশি যে এখানে বিশুদ্ধ সংগীত নিজের স্বাধীন অধিকারটি লাভ করিতে পারে নাই। সেইজন্য এ দেশে তাহাকে ভগিনী কাব্যকলার আশ্রয়েই বাস করিতে হয়। বৈষ্ণব কবিদের পদাবলী হইতে নিধুবাবুর গান পর্যন্ত সকলেরই অধীন থাকিয়া সে আপনার মাধুর্যবিকাশের চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু আমাদের দেশে স্ত্রী যেমন স্বামীর অধীনতা স্বীকার করিয়াই স্বামীর উপর কর্তৃত্ব করিতে পারে, এ দেশে গানও তেমনি বাক্যের অনুবর্তন করিবার ভার লইয়া বাক্যকে ছাড়াইয়া যায়। গান রচনা করিবার সময় এইটে বার বার অনুভব করা গিয়াছে। গুন গুন করিতে করিতে যখনই একটা লাইন লিখিলাম, “তোমার গোপন কথাটি সখী, রেখো না মনে’- তখনই দেখিলাম, সুর যে- জায়গায় কথাটা উড়াইয়া লইয়া গেল কথা আপনি সেখানে পায়ে হাঁটিয়া গিয়া পৌঁছিতে পারিত না। তখন মনে হইতে লাগিল, আমি যে গোপন কথাটি শুনিবার জন্য সাধাসাধি করিতেছি তাহা যেন বনশ্রেণীর শ্যামলিমার মধ্যে মিলাইয়া আছে, পূর্ণিমারাত্রির নিস্তব্ধ শুভ্রতার মধ্যে ডুবিয়া আছে, দিগন্তরালের নীলাভ সূদূরতার মধ্যে অবগুন্ঠিত হইয়া আছে- তাহা যেন সমস্ত জলস্থল- আকাশের নিগূঢ গোপন কথা”।

রবীন্দ্রনাথের গান আজও আমাদের প্রাণের আরাম, কারণ তাঁর গানের বাণীর একটা ধ্বনি মূল্য আছে; আর সুর সেই ধ্বনি মূল্য কে এক অসীম উচ্চতায় পৌছে দেয়। তিনি চেষ্টা করে গান রচনা করেন না, তাঁর অন্তরের উর্বর মৃত্তিকায় গান জন্ম নেয় আর পরম যত্নে সন্তান স্নেহে তিনি তাকে লালন করেন।

১৩০৫ বঙ্গাব্দের ৫ই পৌষ কবি বলছেন, “কাল সন্ধ্যা থেকে এই গানটি কেবলই আমার মনের মধ্যে ঝংকৃত হচ্ছে- “বাজে বাজে রম্যবীণা বাজে। ” আমি কোনোমতেই ভুলতে পারছি নে-

বাজে বাজে রম্যবীণা বাজে।
অমল কমল- মাঝে, জ্যোৎস্না রজনী- মাঝে,
কাজল ঘন- মাঝে, নিশি আঁধার- মাঝে,
কুসুমসুরভি- মাঝে বীণ- রণন শুনি যে-
প্রেমে প্রেমে বাজে।

কাল রাত্রে ছাদে দাঁড়িয়ে নক্ষত্রলোকের দিকে চেয়ে আমার মন সম্পূর্ণ স্বীকার করেছে “বাজে বাজে রম্যবীণা বাজে। ” এ কবিকথা নয়, এ বাক্যালংকার নয়- আকাশ এবং কালকে পরিপূর্ণ করে অহোরাত্র সংগীত বেজে উঠছে।

বাতাসে যখন ঢেউয়ের সঙ্গে ঢেউ সুন্দর করে খেলিয়ে ওঠে তখন তাদের সেই আশ্চর্য মিলন এবং সৌন্দর্যকে আমাদের চোখ দেখতে পায় না, আমাদের কানের মধ্যে সেই লীলা গান হয়ে প্রকাশ পায়। আবার আকাশের মধ্যে যখন আলোর ঢেউ ধারায় ধারায় বিচিত্র তালে নৃত্য করতে থাকে তখন সেই অপরূপ লীলার কোনো খবর আমাদের কান পায় না, চোখের মধ্যে সেইটে রূপ হয়ে দেখা দেয়। যদি এই মহাকাশের লীলাকেও আমরা কানের সিংহদ্বার দিয়ে অভ্যর্থনা করতে পারতুম তাহলে বিশ্ববীণার এই ঝংকারকে আমরা গান বলেও চিনতে পারতুম।

এই প্রকাণ্ড বিপুল বিশ্ব- গানের বন্যা যখন সমস্ত আকাশ ছাপিয়ে আমাদের চিত্তের অভিমুখে ছুটে আসে তখন তাকে এক পথ দিয়ে গ্রহণ করতেই পারি নে, নানা দ্বার খুলে দিতে হয় চোখ দিয়ে, কান দিয়ে, স্পর্শেন্দ্রিয় দিয়ে, নানা দিক দিয়ে তাকে নানারকম করে নিই। এই একতান মহাসংগীতকে আমরা দেখি, শুনি, ছুঁই, শুঁকি, আস্বাদন করি।

কাল কৃষ্ণএকদশীর নিভৃত রাত্রের নিবিড় অন্ধকারকে পূর্ণ করে সেই বীনকার তাঁর রম্য বীণা বাজাচ্ছিলেন; জগতের প্রান্তে আমি একলা দাঁড়িয়ে শুনছিলুম; সেই ঝংকারে অনন্ত আকাশের সমস্ত নক্ষত্রলোক ঝংকৃত হয়ে অপূর্ব নিঃশব্দ সংগীতে গাঁথা পড়ছিল। তার পরে যখন শুতে গেলুম তখন এই কথাটি মনে নিয়ে নিদ্রিত হলুম যে, আমি যখন সুপ্তিতে অচেতন থাকব তখনও সেই জাগ্রত বীনকারের নিশীথ রাত্রের বীণা বন্ধ হবে না- তখনও তাঁর যে ঝংকারের তালে নক্ষত্রমণ্ডলীর নৃত্য চলছে সেই তালে তালেই আমার নিদ্রাভিভূত দেহ- নাট্যশালায় প্রাণের নৃত্য চলতে থাকবে, আমার হৃৎপিণ্ডের নৃত্য থামবে না, সর্বাঙ্গে রক্ত নাচবে এবং লক্ষ লক্ষ জীবকোষ আমার সমস্ত শরীরে সেই জ্যোতিষ্কসভার সংগীত ছন্দেই স্পন্দিত হতে থাকবে।

“বাজে বাজে রম্যবীণা বাজে। ” আবার আমাদের ওস্তাদজি আমাদের হাতেও একটি করে ছোটো বীণা দিয়েছেন। তাঁর ইচ্ছে আমরাও তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাজাতে শিখি। তাঁর সভায় তাঁরই সঙ্গে বসে আমরা একটু একটু সংগত করব এই তাঁর স্নেহের অভিপ্রায়। জীবনের বীণাটি ছোটো কিন্তু এতে কত তারই চড়িয়েছেন। সব তারগুলি সুর মিলিয়ে বাঁধা কি কম কথা! এটা হয় তো ওটা হয় না, মন যদি হল তো আবার শরীর বাদী হয়- একদিন যদি হল তো আবার আর- একদিন তার নেবে যায়। কিন্তু ছাড়লে চলবে না। একদিন তাঁর মুখ থেকে এ- কথাটি শুনতে হবে- বাহবা, পুত্র, বেশ। এই জীবনের বীণাটি একদিন তাঁর পায়ের কাছে গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া তার সব রাগিণীটি বাজিয়ে তুলবে। এখন কেবল এই কথাটি মনে রাখতে হবে যে, সব তারগুলি বেশ এঁটে বাঁধা চাই- ঢিল দিলেই ঝনঝন খনখন করে। যেমন এঁটে বাঁধতে হবে তেমনি তাকে মুক্তও রাখতে হবে- তার উপরে কিছু চাপা পড়লে সে আর বাজতে চায় না। নির্মল সুরটুকু যদি চাও তবে দেখো তারে যেন ধুলো না পড়ে- মরচে না পড়ে- আর প্রতিদিন তাঁর পদপ্রান্তে বসে প্রার্থনা ক’রো- হে আমার গুরু, তুমি আমাকে বেসুর থেকে সুরে নিয়ে যাও।

Leave a Reply

Your email address will not be published.