ডিক্সন চিবান্ডাঃ মন মেরামতির এক অভিনব কারিগর
- লেখা- সুমনশুভদীপ
- ছবি- ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
ছোটবেলায় ঠাকুমা দিদিমাদের সাথে বহু মূল্যবান সময় কাটানোর সুযোগ আমার মতো আরও অনেকেরই নিশ্চয়ই হয়েছে। তবে সেইসব দিনগুলো যে সত্যিই মূল্যবান ছিল তা অবশ্য তখন নয় অনেক পরে বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি। এখন বড় হয়ে গিয়ে আমার মতো অনেকেরই বোধকরি আরও বেশি বেশি করে মনে হয়, অমন স্নেহশীল ঠাকুমা দিদিমা টাইপের একজন মানুষ যদি কাছে থাকতো তাহলে মাঝেমধ্যে তার কোলে মুখ গুঁজে খানিক আবোল তাবোল বকবক করে অনেক মানসিক অশান্তির অবসান ঘটাতে পারতাম অল্পেতেই। পাঠকের মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই হঠাৎ এসব কেন বলতে বসলাম? এই প্রতিবেদন পুরো পড়লে আশা রাখি উত্তর পেয়ে যাবেন।
মাস কয়েক আগে ডঃ পল ফার্মা নামে একজন ডাক্তারের স্মরণ সভায় গিয়েছিলাম। না আমি ওনাকে আগে চিনতাম না। কিন্তু সেদিনের সভায় ডঃ স্থবির দাশগুপ্ত, ডঃ অভিজিৎ চৌধুরী, শ্রী কুমার রাণা এবং আরও বিভিন্ন বক্তাদের বক্তব্য থেকে এবং পরবর্তীকালে নেট ঘেঁটে ওনাকে নিয়ে সামান্য পড়াশোনা করার পরে উপলবদ্ধি করি একজন ভালো ডাক্তার হওয়ার পাশাপাশি কতবড় মানবিক একজন মানুষ ছিলেন ডক্টর পল। স্বল্প জীবনেই কতকিছু করেছেন, সেসব যখন শুনছিলাম আপসেই মুগ্ধতা গ্রাস করছিল। সেদিনের সেই সেমিনারের রেশ আমার মধ্যে বেশ কদিন ছিল, এখনও আছে। ভাবছিলাম এমন কত শত ডাক্তার দেশে বিদেশে নীরবে লড়াই করে যাচ্ছেন এবং লড়াই করতে করতেই একদিন দুনিয়া ছাড়ছেন আমরা তার খবরও রাখিনা বা পাইনা। তখনই মাথায় পুরোনো এই লেখাটার তাগিদ আবার খোঁচা মেরে উঠলো– এই রকমই আর একজন ডাক্তারকে নিয়ে লিখবার কথা ভাবছিলাম অনেকদিন থেকেই, শুরুও করেছিলাম, তারপর আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি। আজ চিকিৎসক দিবসে সেই মানুষটি এবং তাঁর কাজ সম্পর্কে দু চার কথা বলে কিছুটা পাপ স্খলন করতে বসলাম।
আজ চিকিৎসক দিবসে যে ডাক্তার ভদ্রলোকের সাথে আপনার পরিচয় করাবো তাঁর নাম ডক্টর ডিক্সন চিবান্ডা। দুনিয়ার অন্যতম দরিদ্র দেশ জিম্বাবুয়ের বাসিন্দা এই ডাক্তারবাবু আজ সারা দুনিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন তাঁর অভিনব চিকিৎসা পদ্ধতির গুণে। এমনকি আমেরিকার মতন প্রথম বিশ্বের একাধিক দেশও অনুসরণ করছে তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতি। তবে সেসব আলোচনায় যাওয়ার আগে জিম্বাবুয়ে দেশটার অবস্থা নিয়ে দুচার কথা একটু বলেনি। তাহলে বোঝাতে এবং বুঝতে সুবিধা হবে।
![](https://bhokattaa.com/wp-content/uploads/2022/07/WhatsApp-Image-2022-06-28-at-4.49.56-PM.jpeg)
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশে মোট জনসংখ্যার প্রতি হাজারে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ন্যূনতম ২.৩ জনের কম হলে, দেশটিতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়েতে প্রতি এক হাজার মানুষে চিকিৎসকের ঘনত্ব ছিল মাত্র ০.৭৬৩। তাও এই হিসেবটা শরীরের ডাক্তারদের। মনের ডাক্তারের সংখ্যা গোটা দেশে মোট ১৩ জন। আজ্ঞে হ্যাঁ এক কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষের এই দেশে মোট মনোবিদের সংখ্যা ঠিক এটাই। ডঃ চিবান্ডা হলেন সেই তেরো জনেরই একজন। অর্থনৈতিক মন্দা, দারিদ্র, বেকারত্বর মত হাজারো সমস্যায় জর্জরিত দেশটায় মানসিক ভাবে খারাপ থাকা মানুষের পরিমাণ কত হতে পারে সহজেই অনুমেয়। এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ অবস্থায় পৌছালো ২০০৫ সালে।, মুরামবাৎসভিনা নামের এক অপারেশনে সরাসরি ৭,০০,০০০ মানুষ তাদের বাসস্থান হারান। এতে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন আরও ২.৪ মিলিয়ন মানুষ। হাজার নয় লক্ষ লক্ষ মানসিক বিপর্যস্ত মানুষদের কেউ বেছে নিলেন আত্মহত্যার রাস্তা কেউ বা নেশার জীবন। অথচ তাদের বাঁচানোর জন্য,পরিষেবা দেওয়ার জন্য মনোবিদের সংখ্যা মাত্র এই। এই সব দিনে উদ্বিগ্ন চিবান্ডা নাগরিক পরিষেবা দেবার জন্য সামান্য একটা ক্লিনিক এবং সাথে কয়েকজন নার্সের আবেদন জানালেন। কিন্তু দেশের সরকার সেটুকুও দিতে অসমর্থ হল। এই অবস্থায় একজন মনোবিদের নিজেরই অন্য মনোবিদের প্রয়োজন হয়ে পরবে। অথবা তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে কোনো উন্নত দেশে গিয়ে পসার জমিয়ে বসবেন এটাই স্বাভাবিক। স্লোভাকিয়ায় অবস্থিত কোমিনিয়াস ইউনিভার্সিটি থেকে মেডিসিনে গ্রাজুয়েশন করা। পরবর্তী সময়ে ইউনিভার্সিটি অভ জিম্বাবুয়ে থেকে সাইকিয়াট্রি (২০০৪) ও পাবলিক হেলথ (২০০৭) বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করার পর একজন ডাক্তার দুনিয়ার যেকোনো উন্নত দেশে গিয়ে পসার জমিয়ে বসতেই পারতেন। হ্যাঁ ভারতের ইউনিভার্সিটি অফ পুনেতে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের সহযোগিতায় মেন্টাল হেলথ বিভাগে ইন্টারন্যাশনাল ডিপ্লোমার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। কিন্তু এত কিছু ডিগ্রি, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা থাকা স্বত্তেও চিবান্ডা জিম্বাবুয়েতেই রয়ে গেলেন। শুধু তাই না, দেশের মানুষকে সুস্থ করে তুলতে চিবান্ডার মাথায় এলো এক অভিনব পরিকল্পনা যা তাঁকে করে তুললো অনন্য সাধারণ একজন মানুষ। কি সেই পরিকল্পনা? আসুন দেখা যাক।
যেকোনো দেশেই জনসংখ্যার একটা বড় অংশ হলেন বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধারা। যাদেরকে দুনিয়ার প্রায় সমস্ত দেশ এবং দুনিয়ার প্রায় সমস্ত সমাজই খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। মনেই করে এনাদের পক্ষে আর রাষ্ট্রকে দেবার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই। চিবান্ডা ঠিক এনাদেরকেই সমাজের কাজে লাগানোর কথা ভাবলেন। এই ভাবনাই বাস্তবের মাটিতে এসে দাঁড়ালো ২০০৭ সালে। জন্ম নিলো ‘ ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চ ‘ প্রকল্প। সমাজের কাছে অপ্রয়োজনীয় ঠাকুমা দিদিমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ হল অসংখ্য স্মৃতি, অনেক অভিজ্ঞতা সাথে স্নেহ ও আন্তরিকতার উষ্ণতা মিশ্রিত মানবিক একখানি মন। এই সব কিছুর সাথে চিবান্ডা খালি যোগ করে দিলেন কয়েক সপ্তাহের কিছু সহজ প্রশিক্ষণ।
![](https://bhokattaa.com/wp-content/uploads/2022/07/WhatsApp-Image-2022-06-28-at-4.50.26-PM.jpeg)
কিছুদিনের মধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পরলো মানবিক গুণসম্পন্ন প্রশিক্ষিত বহু দিদিমা। যাদের কর্ম পদ্ধতিও ভিন্ন এবং অভিনব। তাঁরা কোনো সাজানো চেম্বারের বদলে বসেন কোনো লেকের ধারে, নদীর পারে বা কোনো পার্কের বেঞ্চে। চিবান্ডার মতে সাজানো গোছানো আবদ্ধ চেম্বারের চাইতে খোলামেলা পরিবেশে কোনো ঠাকুমা দিদিমার কাছে নিজের যন্ত্রণার কথা, দুঃখের কথা মন খুলে বলতে লোকে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করবে। আর হলও তাই। কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা গেল, গ্র্যান্ডমাদার নামে পরিচিত এই মনের ডাক্তারদের দেওয়া সেবা ছাড়িয়ে গেছে প্রত্যাশা। বিবিসিতে (৩০শে জুন, ২০২০) প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, জিম্বাবুয়েতে এখন পর্যন্ত গ্র্যান্ডমা বেঞ্চার্স বা ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চের চিকিৎসা সেবায় পাল্টে গিয়েছে বিষণ্ণতা, হতাশা, আত্মহত্যার প্রবণতাসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকা ৫০,০০০ এরও বেশি মানুষের জীবন। দেশ জুড়ে আড়াই শতাধিক বেঞ্চে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ প্রবীণা কাজ করে চলেছেন এই মহৎ প্রকল্পে। পার্কে, লেকের ধারে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে কোনো এক দিদিমা নিবিষ্ট মনে কারুর কথা শুনে চলেছেন জিম্বাবুয়েতে এখন এক পরিচিত দৃশ্য। বক্তাদের কেউ পারিবারিক হিংসার শিকার, কেউ বা হতাশায় ড্রাগ নিত, কেউ চাকরি হারিয়েছে বা পড়াশোনা করে বসে আছে চাকরিই পায়নি। ডক্টর ডিক্সনের মতে, বেঞ্চে আসা রোগীদের ৪০ শতাংশই নারী এবং তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী পারিবারিক সহিংসতা বা নির্যাতনের শিকার।
![](https://bhokattaa.com/wp-content/uploads/2022/07/WhatsApp-Image-2022-06-28-at-4.50.53-PM-1024x681.jpeg)
“শুধুমাত্র মনের কথাগুলো কাউকে খুলে বলতে না পারার কষ্টেই বহু মানুষের মৃত্যু হয়। আর মানুষ যখন মনের ভেতর কথা জমাতে শুরু করে, সমস্যার সূচনাও হয় ঠিক তখন থেকেই।” ঠিক এটাই মত ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চের একজন দিদিমা জয়েস এনকুবের। দেশের সীমানা পার করে ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চের প্রকল্প ছড়িয়ে পড়েছে কেনিয়া, রুয়ান্ডা, লাইবেরিয়া সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার মতো উন্নত দেশেও। ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চের সাফল্যকে মাথায় রেখে একই ধাঁচে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু জায়গায় ইতিমধ্যেই এই ধরণের প্রকল্প নেওয়া শুরু হয়েছে। নিউইয়র্ক সিটির ডিপার্টমেন্ট অভ হেলথ অ্যান্ড মেন্টাল হাইজিন-এর থেরাপিস্ট ও এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর টাকিশা হোয়াইট বলেন, “মনোবিদের কাছে যাওয়া উচিত কি না, শুধুমাত্র এ দ্বিধা থেকেই বহু মানুষ তাদের মনোরোগ চেপে বেঁচে থাকেন, চিকিৎসা নিতে চান না। কিন্তু ডিগ্রি সমৃদ্ধ মনোবিদ না থাকলেও, নির্ভরযোগ্য শ্রোতার কাছে নিজের মনের কথাগুলো স্বাধীনভাবে বলতে পারার সুযোগ করে দেয় ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চ। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সমাজকে আরও বেশি সুন্দর ও সুখী করে তুলতে এ প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”
![](https://bhokattaa.com/wp-content/uploads/2022/07/WhatsApp-Image-2022-06-28-at-4.51.19-PM.jpeg)
এই পরিষেবাকে আরও আধুনিক রূপে প্রয়োগ করছে কানাডা ২০১৫ সাল থেকে। ‘ বাডি বেঞ্চ ‘ নামের এই প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে সে দেশের কিশোর কিশোরীদের কথা ভেবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক আরও বিভিন্ন কারণে টিনএজারদের ভিতর আত্মহত্যার প্রবণতা মারাত্নক পরিমাণে বেড়ে যাওয়াকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে ‘ বাডি বেঞ্চ ‘। পরিসংখ্যান স্পষ্টই জানাচ্ছে সে কথা।
![](https://bhokattaa.com/wp-content/uploads/2022/07/WhatsApp-Image-2022-06-28-at-4.51.54-PM.jpeg)
প্রতিবেদনের শেষে এসে যেটুকু সংক্ষেপে বলার, কোভিড পরিস্থিতি পার হয়ে এসে বর্তমান পৃথিবীর মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা আরও করুণ আরও বেদনা দায়ক। তাই এখন আরও বেশি বেশি করে আমাদের বোধহয় ডক্টর চিবান্ডার ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চে বসা দিদিমাদের নিজের জীবনে প্রয়োজন। যে দিদিমার কোলে মুখ গুঁজে নির্দ্বিধায় দুঃখের কথা, সম্পর্ক হারানোর যন্ত্রণা নির্দ্বিধায় শেয়ার করা যাবে। কেঁদে হালকা করা যাবে নিজেকে। অর্থাৎ অকপটে বলে ফেলা যাবে অতি আপনজনকেও না বলতে পারা সমস্ত কথাগুলো। তাই মানবজাতির মানসিক স্বাস্থ্যের মেরামতিতে মানবিক দিদিমার সংখ্যা দুনিয়া জুড়ে আরও অনেক অনেক বৃদ্ধি পাক এই কামনা করি সর্বতভাবে।
পুনশ্চঃ দরকারে যোগাযোগের জন্য ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চের লিঙ্ক দিলাম www.thefriendshipbench.org
ডাক্তার চিবান্ডার উদ্ভাবিত বাস্তব এই পদ্ধতিতে সামাজিক সুফলের কথা জেনে ভাল লাগল। সব দেশেই বর্তমানে এমন সমস্যাজর্জর। তাই এদেশেও ‘ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চ’ শুকরতে পারলে সমাজের পক্ষে শুভ হবে।
Khub bhalo laglo lekha ta.. koto kichu ojana amader..
Eairom friendship bench hote pare seta bhabner otit amr..
ডঃ চিবান্ডা 🙏🎈
ভোকাট্টা পরিবারের তরফে ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করবেন।
ভোকাট্টা পরিবারের তরফে অজস্র ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো লাগলে অবশ্যই অন্যদের সাথে লেখাটি শেয়ার করবেন।