টুসির পরীক্ষা- বনানী সেনগুপ্ত

  • লেখা- বনানী সেনগুপ্ত
  • অলঙ্করণ- শুভ্রা

ঠক্ ঠক্ ঠক্….এত রাত্তিরে কে এল রে বাবা! টুসির ঘরের দরজা ভেজান ছিল। বাড়ির লোক এত ফর্মালিটি করবে না নিশ্চয়। একেই আগামীকাল পরীক্ষা, তার ওপর ইতিহাস। ইতিহাস পরীক্ষা শুনলেই টুসির গায়ে জ্বর আসে। কে কবে রাজা হয়েছে, কার ছেলে কি করেছে, কার রাজধানী কোথায় ছিল, এসব মনে রাখা কি চাট্টিখানি কথা!  ইতিহাস বইটা দেখলেই টুসির চোখ দুটো জুড়িয়ে আসে। আজও প্রায় ঘুমিয়েই পড়ছিল, হঠাৎ তার ঘরের দরজায় আওয়াজ…. এত রাত্তিরে কে আসবে? মা, বাবা, ঠাম্মি সবাই তো ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে কি ঠাম্মি দেখতে এসেছে, সে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে টুসি ঘরের দরজা খুলবে বলে চেয়ার থেকে নামতে গিয়ে দেখে, দরজা দিয়ে এক দীর্ঘ দেহী ব্যক্তি প্রবেশ করছেন। অদ্ভুত পোশাক আশাক, যেন কোন রাজা মহারাজা….- একি! কে আপনি?দীর্ঘ দেহী ব্যক্তি স্মিত হেসে বললেন,- আমায় চিনতে পারলি না? এত পড়াশুনা করে কি হল তবে?টুসি হাঁ করে চেয়ে রইল। কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকছে। কোথায় যেন দেখেছে? স্কুলে, পাড়ার মোড়ে, ফুচকার দোকানে? কিছুতেই মনে পড়ছে না কেন। তবু যেন বড্ড চেনা।টুসির মুখ দেখে সেই ব্যক্তি বলে উঠলেন- ওরে পাগল! আমার নাম সিদ্ধার্থ। এবার চিনতে পারলি? – হ্যাঁ? সে আবার কে? আমার ছোট দাদুর এর নাম সিদ্ধার্থ। কিন্তু তিনি তো মারা গেছেন। ও মা গো! আপনি কি দাদু ভূত? মা বাঁচাও আমায়….- চুপ কর হতভাগা। আমি তোর দাদু নই। তোদের চোদ্দ গুষ্টির কেউ নই। ইতিহাসে আর তুই পাশ করবি নে।- আপনি কি ঐতিহাসিক চরিত্র? চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞাসা করে টুসি….- আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। সত্যি করে বলুন তো, who are you?- আমি সিদ্ধার্থ। কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্ধদনের পুত্র।- তুমি গৌতম বুদ্ধ!!!! – এখনও হই নি।- হ্যাঁ??- অত বড় হাঁ করিস না, মাছি ঢুকে যাবে। টুসি মুখটা বন্ধ করে নিল।- যাচ্ছিলাম বোধি বৃক্ষের খোঁজে। ওই বুদ্ধ গয়ায় যাব, নির্বাণ টির্বান লাভ করব। এই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম, দেখি এই ঘরে আলো জ্বলছে। দেখলাম তোর ইতিহাস পরীক্ষা। ভাবলাম ঢুঁ মেরে যাই।- আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না! নেপাল থেকে গয়া যেতে বুঝি কলকাতা পরে রাস্তায়?- অর্বাচীন! বড্ড বাজে বকিস! এইজন্য গত বছর ইতিহাসে গোল্লা পেয়েছিলি।- মোটেই গোল্লা না, একটু কম পেয়েছি। ওই দুই নম্বরের জন্য পাশ করেছি।- দুই নম্বর তো grace দিয়েছে!- আপনি জানলেন কীকরে? – অত কথায় তোর কি! আমরা সব জানি, সাধে কি আমি বুদ্ধ!- বটেই তো। আচ্ছা, এত যখন জানেন তখন একটু বলুন না, আপনার portion এ কি কি প্রশ্ন আসবে? মানে কোন কোন জায়গা ভাল করে পড়ব?- এত specifically বলা বারণ। শুধু দুটো জায়গা বলে দিচ্ছি, লুম্বিনী আর কুশিনগর। লুম্বিনী তে যা হয়েছিল সেখান থেকে পড়া শুরু কর, আর কুশীনগরে গিয়ে থাম। ব্যাস! তোর পাশ করা কেউ আটকাতে পারবে না।- উফ্! আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। – আমি তবে আসি। টা টা….টুসি ইতিহাসের বইয়ের পাতা ওল্টাতে লাগল। হঠাৎ টের পেল, গৌতম বুদ্ধ তাকে বুদ্ধু বানিয়ে গেছেন। ভারী রাগ হল। রেগে মেগে চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবে এমন সময়….- একটু জল দেবে খুকি?- একি একি! কে আপনি? কোথা থেকে এলেন? আর আপনার ঘাড়ে ওটা কে? ও মা গোওওওওওও…. ভূত এল গো, ভূতে জল চাইছে….- চুপ চুপ, চুপ কর খুকি। আমি ভূত নই। তবে ভূতকাল থেকে এসেছি।- এই, আপনাকেও চেনা চেনা ঠেকছে, আপনার পিঠে ওই বাদুড়ের মত যে ঝুলছে, তাকেও। আপনারা কারা?- তুমি কে হে খুকি! আমাদের চেনো না? আমি বিক্রমাদিত্য আর এইটি হল বেতাল। হতচ্ছাড়া সেই যে আমার পিঠে উঠেছে, আর নামেই না। বইতে বইতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম! জল তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাওয়ার যোগাড়।- ওটা বেতাল নাকি? দেখতে কেমন ঝোলার মতো! হে হে হে হে….- বেশি হেস না। নেহাত একটু লাজুক, নাহলে এতক্ষণে আমার পিঠ ছেড়ে তোমার পিঠে চেপে বসত। তারপর প্রশ্নবাণে জেরবার! ইতিহাসের সোজা সোজা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই ইয়ে করে ফেল, আর জলজ্যান্ত বেতাল ঘাড়ে চাপলে তুমি তো পটকে যেতে।টুসির ভারী রাগ হল। মুখে বলল,- আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। ভারী তো ভূত! তা ভূতেরা তো সব জানে, বল তো কাল পরীক্ষায় কি কি আসবে গুপ্ত সাম্রাজ্যের থেকে?- ওমা! তুই জানিস যে আমি গুপ্ত বংশের রাজা? আমার কী ভাগ্যি! সব পড়বি হতভাগা! আমার দাদু থেকে নাতি অব্দি, সব। না যদি পড়িস, তাহলে সংস্কৃত পরীক্ষার আগে কালীদাস কে পাঠিয়ে দেব।আর বেতালকে পাহারায় রেখে যাব।- রক্ষে করুন মহারাজা। আর জিজ্ঞাসা করব না, সব পড়ব, সত্যি বলছি, ছেড়ে দিন আমায়। আর ফাঁকি মারব না। একটুও না….ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে টুসি ইতিহাস বইয়ের আড়ালে মুখ লোকায়।

এমন ভাবে কতক্ষণ কেটেছে জানে না, হঠাৎ একটা ভারী পায়ের শব্দে মুখ তুলল….- কে? কে ওখানে?- আসব? তুমি ভয় পাবে না তো?টুসি ভাবল, কালকের পরীক্ষায় তো পাশ করব না, দেখি এবার কে এলেন!- আসুন। আমি ভয় পাই না।ভারী জুতোর মট মট শব্দ করে একজনের প্রবেশ। ভয় পাই না বলল বটে, কিন্তু দেখে টুসির হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এল। এত স্কন্ধকাটা! এতক্ষন ঐতিহাসিক চরিত্র আসছিল,এবার তো সত্যিকারের ভূত!- ও মা গোওওওওওওও- চুপ! আগেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, খুব তো সাহস দেখালি। এখন কি হল?- আমি কি জানতুম যে আপনি স্কন্ধকাটা! আমি কাঁদব….- বড্ড ছিঁচ কাঁদুনে রে তুই। এই জন্য ইতিহাসে ডাব্বা খাস! – এই দাঁড়াও দাঁড়াও! তোমায় আমি চিনি! – কে বলত?- তুমি তো মুণ্ডুহীন কণিষ্ক!!!- কি বললি!!!!- না না, শুধু কণিষ্ক।- বাঃ! কি বুদ্ধি!- তা মুণ্ডুহীন ক…. থুড়ি শুধু কণিষ্ক, আপনার মুণ্ডু কই? I mean মস্তিষ্ক কই?- সে এক বিশাল গপ্পো। বলতে গেলে ভোর হয়ে যাবে রে!- থাক তবে! কাল আবার পরীক্ষা আছে। পরীক্ষার পরে আসবেন একদিন, শুনব। – সেই। আমার তো কাম কাজ নেই, তোর সাথে গপ্পো করতে আসব। যত্তসব!- আজ এলেন কেন তবে? – সেই কবে থেকে আমার মুণ্ডু খুঁজছি রে। যবে পটল তুলেছি তবে থেকে মুণ্ডু খুঁজে চলেছি। আমার মত দেখতে হতে হবে, আমার মত বুদ্ধি থাকতে হবে, তবে না তার মুণ্ডু নেব।- ঠিক ঠিক।- খুঁজতে খুঁজতে এ পথে যাচ্ছিলাম। দেখলাম ঘরের আলো জ্বলছে, তাই ঢুঁ মারতে এলাম। তোকে দেখলাম।- দেখা হয়ে গেছে মুণ্ডুহীন ক…. থুড়ি শুধু কণিষ্ক? এবার আসুন, আমি পড়ব।- আরে দাঁড়া দাঁড়া…. পুরোটা শোন…. তো মুণ্ডু তো খুঁজছি, মুণ্ডু quest আজও চলছে। In the mean time, তোর ঘরে এলাম, তোকে দেখলাম। মনে হল যেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।- অ্যাঁ???- হ্যাঁ। ওরে তোকে দেখে আমিও তো অবাক! এতো হুবহু আমি। এতদিনে মুণ্ডু ফিরে পেয়েছি। আর ছাড়ছি না। যুগ যুগান্তরের ইচ্ছা আমার আজ পূর্ণ হবে। হর হর মহাদেব….- ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও, মুণ্ডুহীন ক…. ইয়ে শুধু কণিষ্ক…. আমার কাল পরীক্ষা। মুণ্ডু নিয়ে গেলে আমি পরীক্ষা দিতে পারব না! ভ্যাঁ…. – টুসি…. অ্যাই টুসি…. ওঠ ওঠ ওঠ! কি বিড় বিড় করছিস! আজ তোর পরীক্ষা না? মার ডাকে ধর ফর করে উঠে বসে টুসি। উঠেই দৌড়ায় আয়না দেখতে। মুণ্ডু টা স্বস্থানে আছে দেখে খানিক আশ্বস্ত হল। টুসির কাণ্ড দেখে মা রেগে গিয়ে বললেন,- সকালে উঠেই আয়নার সামনে…. ভেঙে ফেলে দেব আজ আমি সব। একেই ইতিহাসে গোল্লা পাস, একটুও পড়াশুনা করিস না। এবার গোল্লা পেলে একদম হোস্টেলে পাঠিয়ে দেব।এই বলে দুড়দাড় করে রান্নাঘরে চলে গেলেন। টুসি মনে মনে ভাবল, উফ্! কি বাঁচা বেঁচেছি। মুণ্ডু তো আছে, এবার নিশ্চয় পাশও করে যাব। মা কি আর জানে, কাল তো মুন্ডুই হারাতে বসেছিলাম। যাই, স্নান করে আসি। রেডি হতে হবে; পরীক্ষাটা দিয়ে আসি। বুদ্ধদেবের আশীর্বাদে এবার ঠিক পাশ করে যাব!

One thought on “টুসির পরীক্ষা- বনানী সেনগুপ্ত

  • November 15, 2020 at 11:41 am
    Permalink

    Bah darun toh…Sanjib chattopadhyay er lekhar moto laglo. Monograhi lekha.

Leave a Reply

Your email address will not be published.